বাউল দর্শন ও সঙ্গীত বাংলার অনেক কৃতী পুরুষকেই আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবল বিমহিত হয়েই থেমে থাকেন নি। স্বীয় সত্তার সাথে গেঁথে নিয়েছিলেন বাউল মতবাদ। বাউল গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছিলেন মানবতাবাদী জীবনচেতনার প্রেরণা। আর ধীরে ধীরে তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন "রবীন্দ্রবাউলে"। বাউল গানের সুর,বাণী ও তত্ত্বকথা যেমন তাঁকে আকৃষ্ট করেছে, তেমনি বাউলের বেশভূষায় তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। আমরা দেখতে পায় এক সময় বাউল ঢঙ্গের পোশাকই হয়ে উঠেছিলো তার নিত্য ব্যাবহার্য। রবীন্দ্রমানসে এই বাউল প্রভাবের মূলে লালনের গান ও তাঁর শিষ্য-সম্প্রদায়ের সাহচর্য সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিলো বলে মনে হয়। মরমিসাধক লালন ও রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ সম্পর্কে দ্বিমত বিদ্যমান। কারো কারো মতে রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আবার কেউ কেউ তথ্য-প্রমাণের অভাবে কেবল জনশ্রুতি ও অনুমানের উপর আস্থা রাখতে পারেন নি। লালন-রবীন্দ্র সাক্ষাৎকার সম্পর্কে প্রথম ঘোষণাটি আসে জলধর সেনের(১৮৬০-১৯৩৯) কাঙাল-জীবনীতে। তিনি লিখেছেনঃ 

"শুনিয়াছি, কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিতে লালন ফকির একবার গান করিয়া সকলকে মন্ত্রনুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। প্রাতঃকাল হইতে আরম্ভ করিয়া অপরাহ্ন তিনটা পর্যন্ত গান চলিয়াছিল; ইহার মধ্যে কেহ স্থান ত্যাগ করিতে পারে নাই"।

অন্যত্র  বসন্তকুমার পালের 'মহাত্না লালন ফকির' গ্রন্থে 'প্রকাশকের নিবেদনে' অজিতকুমার স্মৃতিরত্ন উল্লেখ করেছেনঃ

"নিরক্ষর পল্লীবাসী হইতে আরম্ভ করিয়া আমরা শুনিয়াছি জ্ঞানবৃদ্ধ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ফকিরের সহিত ধর্ম্মালাপ করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছেন। শিলাইদহে মহাকবি রবীন্দ্রনাথের সহিত প্রথম যেদিন তাঁহার ভাবের বিনিময় হয় তাহা জাহ্নবী-যমুনা-মহামিলনের ন্যায় রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গমতীর্থ রচনা করে"।

বিনয় ঘোষ সাক্ষাৎকারের সপক্ষে তা৬র মত প্রকাশ করেছেনঃ

"১৮৮৪-৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বাউল্গানের সংগ্রহটি তার (রবীন্দ্রনাথ) হাতে পড়ার পর যখন বাংলা লোকসাহিত্যের গোপন রত্নভান্ডারের দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল, তার দু-তিন বছরের মধ্যেই মনে হয়, শিলইদহে বিখ্যাত বাউল লালন ফকিরের স্পঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিলো"।

আনোয়ারুল করীম, সুকুমার সেন, মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন, রাসবিহারী জোয়ারদারও লালন-রবীন্দ্র সাক্ষাতের সপক্ষে অভিমত ব্যাক্ত করেছেন। কিন্তু উপরিউক্ত মন্তব্য-অভিমত সবই কল্পিত, অনুমান কিংবা জনশ্রুতি নির্ভর। কেউই তাদের বক্তব্যের সমর্থনে কোনো তথ্য-দলিল উপস্থিত করতে পারেন নি। লালন-রবীন্দ্র সাক্ষাৎকারের ধারনাটি নানাকরনে অনেকেই সমর্থন করেন নি। হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন" আমার মনে হয় এই কাহিনী সম্পূর্ণ কিংবদন্তীর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে"। অন্নদাশঙ্কর রায়ও এ-বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এই ব্যাপারে তার ভাষ্য " দুই জ্যোতিষ্কের সাক্ষাৎকার প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ"। সাক্ষাৎকার সম্পর্কিত দ্বন্দকে আরো বেশি জটিলতর করেছে রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ বিপরিত দুটি মন্তব্য। ১৯২২ সালে শান্তিদেব ঘোষের পিতা কালীমোহন ঘোষকে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেনঃ

"তুমি তো দেখেছো শিলাইদহতে লালন ফকিরের শিষ্যগনের সহিত ঘণ্টার পর ঘন্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত"।

এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট ভাবেই বুঝা যায় রবীন্দ্রনাথ লালনের সাথে নয় তাঁর শিষ্যদের সাথেই দেখা সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু অন্যত্র, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তার সচিব সুধীরচন্দ্র কর ২০ জুলাই ১৯৩৯ বসন্তকুমারকে এক লিখিত পত্রে জানানঃ

সবিনয় নিবেদন,

কবি আপনার চিঠি পেয়ে সুখি হয়েছেন।আপনাকে এই মহৎ কাজে সাহাজ্য করতে পারলে তিনি আরো সুখি হতেন সন্দেহ নাই। ফকির সাহেবকে তিনি জানতেন বটে কিন্তু সে তো বহুদিন আগে; বুঝতেই পারেন এখন সে সব সুদূর স্মৃতির বিষয় তার মবে তেমন উজ্জ্বল নয়।........................"

'ফকির সাহেবকে (লালন) তিনি (রবীন্দ্রনাথ) জানতেন'— এই উক্তিটি অবশ্য উভয়ের আলাপ-পরিচয়ের ধারণাকে সমর্থন করে। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে জমিদারীর দায়িত্বভার নিয়ে আসেন ১৮৯০ সালের শেষের দিকে, লালনের মৃত্যু ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর। সুতরাং ঐ সময় উভয়ের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে বাল্যকাল থেকেই শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের আসা-যাওয়া ছিলো, তখন তাদের দেখা হলেও হতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত তথ্য প্রমাণাভাবে তাদের এই ঐতিহাসিক সাক্ষাতের ঘটনাটি গ্রহনযগ্যতা পাচ্ছে না।

রেফারেন্সঃ লালন সাঁই-আবুল আহসান চৌধুরী।

 

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত লালনের প্রতিকৃতিঃ ১৮৮৯