ভূমিকম্প ঝুঁকির প্রথম ২০ শহরের তালিকায় ঢাকা, কী ঘটবে সামনে?
ভূমিকম্প বিশ্বের কোথাও না কোথাও হচ্ছে প্রতিদিনই হচ্ছে। তবে সেইসব স্থানে এর ক্ষতির পরিমান বেশি যেখানে অপরিকল্পিতভাবে নগারায়ন হয়েছে।
এই হাসিমুখ ধরে রাখতে চাই এখনি পরিকল্পনা।
নেপালের ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সংকেত। এ থেকে শিক্ষা না নিতে পারলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পড়বে বাংলাদেশ। কেননা বিশ্বের ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প শহরের একটি ঢাকা। আগে থেকেই সতর্ক হোন।
গত ২১ এপ্রিল শনিবার নেপালের ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত মারা গেছে ৪ হাজারের উপরে। সংখ্যা আরো বাড়বে। এই ভূমিকম্পে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ কেপে উঠেছিলো। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা তিন। নেপাল থেকে ৭৪৫ কিলোমিটারের দুরের বাংলাদেশে এ ভূমিকম্পের পর শঙ্কা-আতঙ্ক বেড়েছে। কারণ নেপালে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের পর ৬ মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প সংগঠিত হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে এ ধরনের ভূমিকম্প সংগঠিত হ্বার সম্ভাবনা কতটুকু। আর ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিই বা কি ধরনের হবে যদি বাংলাদেশে তা সংগঠিত হয়।
ভূমিকম্প কেন হচ্ছে?
আড়াই কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ভারত একটি আলাদা দ্বীপ ছিল। এই দ্বীপটি এশিয়ার সঙ্গে ধাক্কা খায়। এর ফলে তৈরী হয় হিমালয়সহ বেশ কিছু পর্বত। ভারতীয় পে্লটটি এখনো একটু একটু করে ঢুকছে মধ্য এশীয় টেকটোনিক পে্লটের নিচ দিয়ে। এর ফলে এই অঞ্চলের পবর্তগুলো এখনো নতুন করে আকার পাচ্ছে। প্রতি বছর এই দুটি পে্লট দুই ইঞ্চি করে পরস্পরের দিকে সরে আসছে। এতে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড চাপ। টেকটোনিক পে্লট হচ্ছে ভূত্বকের বিশাল খণ্ড, যা সঞ্চরণশীল।
দেখুন ভূমিকম্পের প্লেটের মুভমেন্ট।
যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড রথারি এ অঞ্চলের ভূমিকম্প নিয়ে বিস্তর গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। তিনি এ বিষয়ে সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, হিমালয়ের পর্বতমালা ভারতীয় পে্লটের ওপর দিয়ে প্রবলভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। সেখানে দুই থেকে তিনটি বড় ধরনের চ্যুতি রয়েছে। আর আছে কিছু খুব মৃদু গতিতে সঞ্চরণশীল চ্যুতি। এগুলোর সঞ্চরণের কারণেই ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশে কী ভূমিকম্পের উত্পত্তিস্থল হবে?
বাংলাদেশের ভূমিকম্পবিষয়ক সর্বশেষ ২০০৯ সালের একটি ঝুঁকিবিষয়ক গবেষণা হয়। ওই গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের ভেতরে ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো যে ভূগর্ভস্থ ফাটল ছিল, তা এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ভেতরে মাঝারি বা তীব্র ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই বলে ওই গবেষণায় বলা হয়।
ওই গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় ধরনের ভূমিকম্প সংগঠিত হবার ভয় নেই, তবে এ অঞ্চলের অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ তিন দেশ মিয়ানমার, নেপাল ও ভারতের মধ্যবর্তী বাংলাদেশ হওয়ায় এর প্রভাব এখানেও পড়বে। এই এলাকায় ৮ থেকে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প হলে তা বাংলাদেশে বড়জোর মাঝারি মাত্রায় অনুভূত হবে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আক্তার হুমায়ুন 'EARTHQUAKES OF DHAKA' শীর্ষক শীরোনামে এক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে যেমন রয়েছেন। তেমনিভাবে ঢাকা বিশ্বের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ২০ শহরের একটি।
বাংলাদেশ থেকে কতদূরে ভূমিকম্প।
গবেষণায় তিনি বলেন, ৪৫০ বছরের ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, ঢাকা ভূমিকম্পের ঝঁকিতে থাকা বিশ্বের অন্যতম ২০ শহরের একটি। এ অঞ্চলে তিনটি পে্লট সক্রিয় রয়েছে। এগুলো হলো ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় পে্লট, ইউরোশিয়া পে্লট ও মিয়ানমার মাইক্রোপে্লট। এর মধ্যে ভারতীয় ও ইউরোশিয়া পে্লট প্রতি বছর পরস্পরের দিকে ২ ইঞ্চি করে এগিয়ে আসছে। আর মিয়ানমার মাইক্রো পে্লটটি দেশটির উত্তর পূর্বে ১ ইঞ্চির কম করে এগিয়ে যাচ্ছে।
মিয়ানমারের এই প্লেটটির কারণে ভারতের আসামের সিলংয়ে একটি ফল্ট বা ফাটল হয়েছে যা ৩০০ কিলোমিটার উত্তর দক্ষিণে দীর্ঘ সিলেটের সুরমা বেসিনে এসে পৌছেছে। আর মিয়ানমারের মাইক্রো প্লেটটির আরেকটি দিক বাংলাদেশের দক্ষিণের চট্রগ্রাম থেকে সুমাত্রার দিকে যাচ্ছে। এই প্লেটটির কারণে মিয়ানমারে ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
অপরিকল্পিত ঢাকার এসব ভবনের ৯০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশের প্লেটটি এখন নিষ্ক্রিয় হওয়ায় বাংলাদেশের ভেতরে বড় ধরনের কোন ভূমিকম্পের এই মূহুর্তে আশঙ্কা নেই। কিন্তু ভারতের বিহার, নেপাল, ভারতের আসাম ও মিয়ানমারের পে্লটে ফাটল বা চু্যতি থাকায় এসব অঞ্চলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে তার বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে সিলেট, উত্তরবঙ্গ ও ঢাকা অঞ্চলে তার ব্যপক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা থেকে মিয়ানমার ফাটলের দূরত্ব ৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার।
কারণ হিসেবে সৈয়দ আক্তার হুমায়ুন তার গবেষণায় বলেছেন, পৃথিবীর সব থেকে বড় ডল্টো হলো ব্রক্ষ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনা। এটা নবগঠিত একটি নরম মাটির এলাকা। এখানে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে এখানে যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে তা ঝুঁকিতে পড়বে।
নেপালে যা হয়েছে
ভূমিকম্প গবেষকেরা বলছেন, ১০ কোটি টন টিএনটি বিস্ফোরিত হলে যে শক্তি নির্গত হয় ৭ দশমিক ৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পে সে মাত্রার কম্পন হয়েছে। হায়দরাবাদভিত্তিক ন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক হার্শ কে গুপ্ত বলেন, এই অঞ্চলে বিশাল চ্যুতির কথা আমরা জানি, যা বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটায়। রিখটার স্কেলে ৮ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার সিরিজ ভূমিকম্পের জন্য এই চু্যতিগুলো দায়ী। তাই বলা যায়, এই অঞ্চলের সম্ভাব্য শক্তিশালীতম ভূমিকম্পের মধ্যে এটি পড়ে না। শক্তি নির্গতের কথা বললে বলা যাবে, ওই অঞ্চলে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত আছে তার ৪ বা ৫ শতাংশের বেশি শক্তি এই ভূমিকম্পে নির্গত হয়নি।'
যেকোনো সময় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আসতে পারে। ভূমিকম্প ঘটে যাওয়ার দুই মাস পরেও এ ধরনের ঝুঁকি থেকে যায়। এ ধরনের পরাঘাত বা কম্পন কখন হবে, তা বলা সম্ভব নয়। এটা প্রতিরোধেরও কোনো উপায় নেই। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পূর্ব সতর্কতা জরুরি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের নাগাসাকি শহরে 'ফ্যাট ম্যান' নামের একটি পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছিল। এতে প্রায় ৪০ হাজার) মানুষ নিহত হন। নাগাসাকি শহরটি সম্পূর্ণ ধুলিস্যাত্ হয়ে যায়। ফ্যাট ম্যান' বোমার শক্তি ছিল ২০,০০০ টন (বিশ হাজার) টিএনটি'র (ট্রাই নাইট্রো টলুইন) সমতুল্য। এরকম ৫ হাজার বোমা একসঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটালে যত শক্তি নির্গত হবে, তা ১০ কোটি টন টিএনটি'র সমতুল্য। পারমাণবিক বিস্ফোরণের শক্তির একক হিসেবে টন টিএনটি' ব্যবহার করা হয়। ভুমিকম্পের শক্তি বোঝানোর জন্যেও এই একক ব্যবহূত হয়। তার মানে নেপালের পোখরার ভূ-অভ্যন্তরের ১৫ কিলোমিটারে ফ্যাট ম্যান বোমার মত ৫ হাজার বোমা বিস্ফোরণ সমতূল্য ভূমিকম্প হয়েছে।
গত ৮০ বছরের মধ্যে নেপালে গতকালের ভূমিকম্পই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন, এই এলাকায় এর চেয়েও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।
নেপালে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের আগেও বিজ্ঞানীরা নেপালে এ বিষয়ক বৈঠক করেছেন। ভূমিকম্প হওয়ার ঠিক আটদিন আগে আমেরিকা, ভারতসহ সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ওই বৈঠক করেন। তারা আগে ভাগেই নেপালকে জানিয়ে দেয় যে, সেখানে বড় ধরনের একটি ভূমিকম্প হবে। তবে ভূমিকম্পটি যে এতো তাড়াতাড়ি হবে সেটা বিজ্ঞানীরা বলতে পারেনি। কিন্তু এতো বড় ধরনের ভূমিকম্প হবে এটা তারা নিশ্চিত করেই বলেছিলেন। খুব দ্রুত হবে সেটাও বলেছিলেন।
২০১২ সিনেমার ভূমিকম্পের ভবিষ্যাত বানী করেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী শংকর। তবে নেপাল ভূমিকম্পের পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভারতের বাস্তবের বিজ্ঞানী খড়গপুরের আইআইটির অধ্যাপক শঙ্কর কুমার বলেছেন, ছোট আকারের নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণের সমান শক্তি নির্গত হয়েছে এই ভূমিকম্পে। কিন্তু ভিন্নভাবে বললে, ৭ দশমিক ৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পে আমরা ভাগ্যবান। কারণ, এখানে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারত। মূল বিষয়টি হচ্ছে, কী পরিমাণ শক্তি নির্গত হচ্ছে সেটি। ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তা ৭ দশমিক ৯ মাত্রার চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ গুণ বেশি।'
জিওহ্যাজার্ডসের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ব্রায়ান টাকার বলেন, নব্বইয়ের দশকে তার প্রতিষ্ঠান পূর্বাভাস দিয়েছিল যে ১৯৩৪ সালের মতো ভূমিকম্প যদি আবার ঘটে তবে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাবে। কারণ নেপালের শহরগুলোতে বড় বড় দালানকোঠা উঠছে যা সহজেই ভেঙে যাবে। চলতি মাসেই জিওহ্যাজার্ডস তাদের তথ্যে জানিয়েছে, নেপালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সাড়ে ছয় শতাংশ এবং কাঠমান্ডু অন্যতম বড় শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। শুধু কাঠমান্ডুতেই ১৫ লাখ মানুষ বাস করছে।
জিওহ্যাজার্ডস ইন্টারন্যাশনাল নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার মতে, প্রতি ৭৫ বছর পর পর নেপালসহ ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প আঘাত হানছে। ৮১ বছর আগে ১৯৩৪ সালে ৮ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে নেপালের ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। এর উত্পত্তিস্থল ছিল এভারেস্ট থেকে ছয় মাইল দক্ষিণে। ১৯৮৮ সালে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্পে এক হাজার মানুষ মারা যান।
বুয়েটের সীমক্ষায় ঢাকার ভবন ভূমিকম্প সহনীয় নয়
বাংলাদেশ প্রকেৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটের) সামপ্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এলাকার ভবনগুলোর অর্ধেকই ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে নির্মিত হচ্ছে না। ৯০ শতাংশ ভবনের গাড়ি রাখার স্থানটির (কার পার্কিং) অবকাঠামো এমনভাবে নির্মিত হচ্ছে, যা ভূমিকম্পের সময় ভবনটিকে সুরক্ষা দিতে পারবে না।
বুয়েটের ওই সমীক্ষায় ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে নির্মিত ১৫০টি ভবন পরীক্ষা করা হয়েছে। পুরান ঢাকার ৬০টি মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন পরীক্ষা করে বুয়েটের পুরকেৌশল বিভাগের প্রকেৌশলীরা দেখতে পেয়েছেন, সেগুলোর বেশির ভাগেরই ভূমিকম্প প্রতিরোধকব্যবস্থা নেই। এই ভবনগুলো মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার অর্থাত্ সাড়ে ছয় থেকে সাত মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ প্রকেৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকেৌশল বিভাগের পক্ষ থেকে 'ঢাকা শহরের ভবনের ভূমিকম্প বিপন্নতা যাচাইকরণ' শীর্ষক এক গবেষণা সমীক্ষায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর আরবান সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহায়তায় পরিচালিত ওই সমীক্ষা পরিচালিত হয়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, একটি ভবনকে ভূমিকম্প প্রতিরোধক করতে প্রতি বর্গফুটে অতিরিক্ত ৫ থেকে ১০ টাকা খরচ পড়ে। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ওই খরচ কমাতে ভবনগুলোতে ভূমিকম্প প্রতিরোধকব্যবস্থা রাখছে না। অনেক ক্ষেত্রে ভবনের সেৌন্দর্য বাড়াতে ও অসচেতনতার কারণেও ভবনে ভূমিকম্প প্রতিরোধকব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না।
সমীক্ষার প্রয়োজনে বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট কোম্পানি নির্মিত রাজধানীর বনানী, মিরপুর, ইব্রাহিমপুর, লালমাটিয়া ও উত্তরা এলাকার ১৫০টি ভবন পরীক্ষা করা হয়। বেশ কিছু নামী-দামি নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের ভবন ভূমিকম্পের কারণে বিপন্ন হতে পারে বলে ওই পরীক্ষায় দেখা গেছে।
এই ভবনগুলোর ক্ষেত্রে মূলত তিনটি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, ভূমিকম্পের সময় ভবনের নিচের মাটি যে মাত্রায় কেঁপে উঠবে, ভবনটিও একই মাত্রায় কেঁপে উঠছে কি না। কেঁপে উঠলে বুঝতে হবে, ভবনটি ভূমিকম্পের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প সহনশীল ভবনের বিম ও কলামের সংযোগস্থলে চার ইঞ্চি পর পর রডের রিং দিতে হয়। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অর্ধেক ভবনেই সাত থেকে আট ইঞ্চি পর পর রডের রিং দেওয়া হয়েছে। এতে ভবনটির ভিত্তি শক্ত হয় না। তৃতীয়ত, বেশির ভাগ নতুন ভবনের নিচতলা গাড়ি রাখার জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। এ ধরনের ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ওপরের তলার চেয়ে নিচতলার ফাঁকা স্থানের বিম অপেক্ষাকৃত মোটা হতে হবে। কিন্তু ৯০ শতাংশ ভবনে নিচ ও ওপরের তলার বিমের আকৃতি সমান রাখা হয়েছে। ভবনের চারপাশ ফাঁকা ও দেয়াল না থাকায় নিচের তলাটি দুর্বল থেকে যায়।
এই তিনটি শর্ত অনুসরণ না করে নির্মাণ করলে, ছয় থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্পে পুরো ভবনটি ভেঙে পড়তে পারে ।
শীর্ষ ঝুঁকিতে ঢাকা!
বাংলাদেশের পে্লটটি নিষ্ক্রিয় হলেও ভূমিকম্পের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে এরকম সারা পৃথিবীর ২০ শহরের একটি ঢাকা। কারণ হলো মিয়ানমারের মাইক্রোপে্লটে যদি ভূমিকম্প হয় তাহলে এর থেকে ৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার দুরের ঢাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে নেপাল বা ভারতের বিহার বা আসামে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে তার প্রভাব ঢাকায় বাজেভাবে পড়বে। এরকমটিই বলছেন সৈয়দ আখতার। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ঢাকাতে জলাভূমি ভরাট করে এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড না মেনে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। এতে মাঝারি ভূমিকম্পেও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার মোট ভূমির ৭০ শতাংশ মাটিই নতুন। এসব অঞ্চলে জলাভূমি ভরাট করে বাড়ি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এসব অঞ্চলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প যদি মাটির বেশি গভীরে না হয় তাহলেই এ অঞ্চলটিতে ব্যপক ক্ষতি হবে।
ঝুঁকিপ্রবন এলাকা ও ঝুঁকিমুক্ত ভবন নির্মাণে আপনার যা করনীয়
যাত্রাবাড়িসহ পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকার মাটি লাল বা পুরানো নয়। এসব মাটির কোথাও কোথাও পিট কয়লাও রয়েছে। এ হিসেবে ঢাকার মোট এলাকার ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব অঞ্চলে ভবন নির্মাণ করলে মাটির ১৩ থেকে ২৮ মিটার গভীরে বা ৪২ ফুট ৭ ইঞ্চি থেকে ৯১ ফুট ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত গভীরে ফাউন্ডেশন করতে হবে। এ সমীক্ষা সরকারের।
এসব অঞ্চলের মাটির গভীরে যেসব পদার্থ পাওয়া গেছে যেমন নরম কাদা, পিট কয়লার স্তরগুলো কম করে হলেও ১৩ মিটার পর্যন্ত গভীর। কিছু কিছু স্থান রয়েছে যা এসব নরম কাদা, পিট কয়লার স্তরগুলো ২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে রয়েছে। ফলে এসব স্থানে যদি সাধারণ ফাউন্ডেশনের মত করে বাড়ি বা ভবন বানানো হয় তাহলে তা ঝুকিপূর্ণ। আফতাবনগরসহ পূর্বাঞ্চলেই নয় সরকারের ঝিলিমিল প্রকল্পের এলাকা, গুলশান, নিকেতন, উত্তরা, মিরপুরের ঝুঁকিমুক্ত ভবন নির্মাণ করতে ৪২ ফুট ৭ ইঞ্চি থেকে ৯১ ফুট ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত গভীরে ফাউন্ডেশন করতে হবে। এসব নিয়ম কানুন মেনে ভবন নির্মাণ করলে ভারতের আসামে বা বিহারে, নেপালে কিম্বা মিয়ানমারের ভূমিকম্প যদি ৮ মাত্রারও হয় তাহলে তার প্রভাব ঢাকায় এসে পড়লেও খুব ক্ষতির স্বীকার হবে না ঢাকা।
আমাদের স্মরণ রাখা দরকার, নেপাল, ভারত বা মিয়ানমারের ভূমিকম্পে যদি ঢাকা শহর মারাত্মকভাবে কেপে উঠে তাহলে কী হবে পরিস্থিতি তা আন্দাজ করা যায় না। কারণ ঢাকাতে যেভাবে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই ভবন নির্মাণ হচ্ছে তাতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী হবে এটা আন্দাজ করা যায়।
যে মাটিতে ভবন করবেন।
যারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটি বাড়ি বানাবেন তারা সেই বাড়ি বানাতে গিয়ে বাড়তি কিছু অর্থ যুক্ত করলেই ভবনটি নিরাপদ হবে। জাপানে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সাধারণ একটি ব্যপার। গত ছয়দিন আগেও জাপানে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু জাপানে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প সহনীয় করেই নির্মাণ করা হয়।
নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করা ও না করার চিত্র।
আপনার ভবন নির্মাণের আগে সেখানকার মাটি পরীক্ষা করুন। দেখুন লাল মাটি পেতে কত গভীরে যেতে হয়। সেটা যত গভীরই হোক, শক্ত মাটির উপর বাড়ি তুলুন। ভবন নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকেৌশল ব্যবহার করুন। নিরাপদে থাকুন, অন্যদের নিরাপদে রাখুন।
জাপানের ভূমিকম্পের শেষ চিত্র।
No comments:
Post a Comment