বিশেষ সাক্ষাৎকার
হাসিনাকে রেখেও বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে
বিশেষ সাক্ষাৎকার: দেশজুড়ে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোটের ঘোষিত অবরোধ চলছে, জাতীয় রাজনৈতিক জীবনে চলছে অচলাবস্থা। এই পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতি ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দুই শিক্ষক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন–অর–রশিদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে নির্মূল করতে চাইলেও তারা কেউ তা পারবে না। আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে এই দল দুটিই সম্ভাবনাময় অবস্থানে থাকবে। বামপন্থী, রাজাকার বা স্বৈরাচারের পরিচয় যাদের আছে, তারা কেউ তাদের বিকল্প হবে না।
প্রথম আলো : বর্তমানের প্রায় দমবন্ধ পরিস্থিতি উতরানো কী করে সম্ভব?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এর উত্তর দিতেই আমি ওই কথা বললাম। যেহেতু কেউ কাউকে নিঃশেষ করতে সক্ষম হচ্ছে না, তখন প্রজ্ঞা নির্দেশিত পথ হচ্ছে তাদের অবশ্যই সহাবস্থান মেনে নিতে হবে। সম্মানজনক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল হয়ে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে একত্রে বসবাস করার কৌশল রপ্ত করতে হবে। তাই আলোচনা ও সংলাপ ছাড়া আমি অন্য কোনো বিকল্প দেখি না।
প্রথম আলো : অব্যাহত অবরোধকে আপনি কতখানি গণতান্ত্রিক মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এটা একটি প্রতিবাদের ভাষা। বাংলাদেশে কতটুকু গণতন্ত্র আছে, তা নিয়ে আমি প্রশ্ন করব না। অনেকে প্রশ্ন করেন। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির তো প্রতিবাদ করার একটি ছোট জায়গা থাকবে না? সেই জায়গা মানে সভা করা, মিছিল করা। এটুকু যখন না থাকে তখন বিকল্প থাকে কি? অবরোধের পরের ধাপ হয়তো আরও ভয়ংকর হতে পারে। তার মানে যেটা বঙ্গবন্ধু দেখিয়ে গেছেন, তিনি ২৫ দিনের অসহযোগ করেছিলেন।প্রথম আলো : আপনি কি আশঙ্কা করছেন যে খালেদা জিয়া অবরোধের পর অসহযোগের ডাক দিতে পারেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : তাদের চিন্তাভাবনা কী, তা আমি জানি না। তবে কথা হলো বাড়িতে পর্যন্ত তিনি থাকতে পারছেন না, অফিস পর্যন্ত ঘেরাও হয়েছে। মানে কথা বলার সুযোগ যখন নেই, প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ যখন নেই, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী দিয়ে বিরোধী দল দমন চলছে, তখন অবরোধের বিকল্প কি আছে?
প্রথম আলো : জনগণ এর প্রতি সাড়া দিচ্ছে? কিছুটাও কি সফল বলা যায়?
এমাজউদ্দীন আহমদ : কিছুটা তো সফল বলব। তার কারণ মফস্বল এলাকাগুলোতে যেখানে জনগণ কিছুটা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে ভালো সাড়া মিলছে।
প্রথম আলো : সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার যেমন, তেমন বিএনপির বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ রয়েছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর নয় কি?
এমাজউদ্দীন আহমদ : হতে পারে। এবং হচ্ছেও তাই। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এসব ঘটছে। ১৫৪ জন বিনা ভোটে এবং ১৪৬টিতে নামকাওয়াস্তে ভোট হলো। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ এড়িয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাংসদ হওয়া কি গণতন্ত্রের জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা?
প্রথম আলো : অনেকের মতে, শক্তি প্রয়োগ করে টিকতে পারলেই এখানে গণতন্ত্র হয়। এর নজির হলো জিয়ার গণভোট, এরশাদের ভোট ডাকাতির নির্বাচন। তাই বিএনপি-জাপা পারলে আওয়ামী লীগ পারবে না কেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ভোটারবিহীন নির্বাচন ১৯৯৬ সালের ঘটনা।
প্রথম আলো : জিয়ার হ্যাঁ-না ভোট আরও আগের ঘটনা, পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সময় দিয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগকে সময় দিলে ক্ষতি কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : জিয়াউর রহমান জনগণের কাছে গিয়ে ভোট চেয়েছিলেন। এরশাদও গেছেন। তাঁরা যদি জনগণকে সেই সুযোগটা দিয়ে অগ্রসর হতেন তাহলেও তো একটা কথা ছিল, সেটাও তো নয়।
প্রথম আলো : বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে ভুল করেনি?
এমাজউদ্দীন আহমদ : প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন নির্বাচনটা বাধ্যবাধকতার জন্য করছি। একাদশের জন্য আমরা আলোচনা করব। নির্বাচন বর্জন ভুল হবে কেন। আওয়ামী লীগের দাবিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়েছিল।
প্রথম আলো : জিয়ার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়নি। বিএনপির অধীনে আওয়ামী লীগ ভোটে গেছে। এখন বিএনপি পারবে না কেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : পারবে না, তার কারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অপরিহার্য, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আমলাতন্ত্র, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় দলীয়করণের মাত্রা চোখে পড়ছে না? ইকোনমিস্ট বলেছে, বাংলাদেশের রাজনীতি বিষাক্ত হয়ে গেছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দলীয়করণকৃত ও বিকৃত হয়েছে।
প্রথম আলো : তাহলে বিএনপির পক্ষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর নির্বাচন করা সম্ভব নয়?
এমাজউদ্দীন আহমদ : না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, কথা সেটা নয়। আমি বিএনপির পক্ষে কথা বলছি না। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে আমার বক্তব্য হলো, দেশে যখন এ রকম সংকট বিদ্যমান, তখন সংলাপ ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ আছে কি?
প্রথম আলো : আপনি কি এই ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে সংলাপে বসলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও নির্বাচনে যেতে রাজি হতে পারে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : তা তো বটেই। অর্থপূর্ণ সংলাপ করতে হলে উভয় পক্ষকেই খানিকটা ছাড় দিতে হবে।
প্রথম আলো : আপনার সুপারিশের অংশ হিসেবে বিএনপি যদি এখনই শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার একটি ইঙ্গিত দেয়, তাহলে কি রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমন বা আওয়ামী লীগকে আলোচনার টেবিলে আনতে সেটা সহায়ক হতে পারে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : বলেছেন ঠিকই। বিএনপি যদি এ রকম কোনো বক্তব্য দেয়, সেখানে দুটো কথা থাকতে হবে। প্রথমত, নির্বাচনটা যাতে সুষ্ঠু হয়, দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্দলীয় হতে হবে তা আমি বলছি না, কিছুদিন আগে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় যেমনটা হলো।
প্রথম আলো : তার মানে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ঠিক তাঁকে রেখেই। এ রকম একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতেই পারে। এবং সেটা স্বচ্ছন্দে হতে পারে। সে কারণেই আমি বলি দুই পক্ষকেই খানিকটা ছাড় দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে।
প্রথম আলো : নির্বাচন যখনই হোক, এ রকম একটি আগাম বোঝাপড়ার জন্য দুই পক্ষই লিখিতভাবে এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে পৃথক বিবৃতি দিতে পারে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সেটা তারা পারে।
প্রথম আলো : কে আগে করবে, সেটা নিয়ে তো গোল বাঁধতে পারে। এটা নিরসনে নাগরিক সমাজের কোনো উদ্যোগকে কি বেশি সহায়ক মনে হয়?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সেটা সব থেকে উত্তম। ৫ থেকে ১০ জন একত্র হতে পারেন। তবে আগে এ নিয়ে দুই নেত্রীর সঙ্গে আগাম সলাপরামর্শ করতে হবে। তাঁরা বলবেন আমরা একটি সংলাপ চাই। আপনারা রাজি থাকলে আমরা উদ্যোগ নিতে পারি। যাঁরা শ্রদ্ধেয় আছেন তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে পারেন। এ রকম একটি বোঝাপড়ার কথা শোনার জন্য দুই দলেই বহু যোগ্য ব্যক্তি আছেন। প্রধানমন্ত্রীকে রেখে একটি সমঝোতার চেষ্টা হতে পারে।
প্রথম আলো : কিন্তু তেমন পরিবেশ সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তারেক রহমানের কটূক্তির মতো কিছু বিষয় অনেকে বাধা মনে করেন। ওই কটূক্তি সমর্থনযোগ্য?
এমাজউদ্দীন আহমদ : না। একটা তরুণ ছেলে, যখন তার বাবা সম্পর্কে বলা হলো যে তিনি পাকিস্তানের চর বা ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা, বা রাজাকার—এমন একটি প্রেক্ষাপটেই তিনি আসলে বলেছেন। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে দেখার সূচনা হওয়া উচিত। এখানেও একটি সমঝোতা সৃষ্টিতে জ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা সক্রিয় হতে পারেন। তখন তিনি (তারেক) তাঁদের সিদ্ধান্ত মানতে অযুক্তিসংগত মনোভাব দেখাবেন বলে আশা করি না। জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে তিনি তাঁর ওই অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেন।
প্রথম আলো : বিএনপি ভারতের সহায়তা চেয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।
এমাজউদ্দীন আহমদ : কেবল ভারত বলব না, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিএনপির সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার প্রতি একটা সমর্থন আছে।
প্রথম আলো : বিজেপির মনোভাব ইতিবাচক?
এমাজউদ্দীন আহমদ : বিজেপি সরকারের মনোভাব নেতিবাচক মনে হয়নি।
প্রথম আলো : মিডিয়ার স্বাধীনতাকে কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সংবাদপত্রের কণ্ঠ যদি রুদ্ধ করা হয় তাহলে আর ওই মুখে গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না।
প্রথম আলো : অব্যাহত অবরোধেও সংলাপ নিশ্চিত না–ও হতে পারে। আবার সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপি অবরোধ আরও প্রলম্বিত করতে না–ও পারে। মোট কথা অবরোধ বিএনপির একমাত্র বিকল্প কি না?
এমাজউদ্দীন আহমদ : আমি অন্য বিকল্প দেখি না। তবে আগেই যেমনটা বলেছি, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের মতো একটা কিছু শেষ পর্যায়ে থাকতে পারে। বিএনপির দুর্বলতা আছে। তার বিপুল জনপ্রিয়তাও স্পষ্ট। তবে রাজনীতিকেরা মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে প্রাণ পাওয়া বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত করে কেবল বক্তৃতা দেওয়ার রাজনীতি থেকে বিরত হবেন—আমি অন্তত এতটুকু আশাবাদ শেষ মুহূর্তে পোষণ করতে চাই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ
এমাজউদ্দীন আহমদ : ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : হতে পারে। এবং হচ্ছেও তাই। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এসব ঘটছে। ১৫৪ জন বিনা ভোটে এবং ১৪৬টিতে নামকাওয়াস্তে ভোট হলো। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ এড়িয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাংসদ হওয়া কি গণতন্ত্রের জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা?
প্রথম আলো : অনেকের মতে, শক্তি প্রয়োগ করে টিকতে পারলেই এখানে গণতন্ত্র হয়। এর নজির হলো জিয়ার গণভোট, এরশাদের ভোট ডাকাতির নির্বাচন। তাই বিএনপি-জাপা পারলে আওয়ামী লীগ পারবে না কেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ভোটারবিহীন নির্বাচন ১৯৯৬ সালের ঘটনা।
প্রথম আলো : জিয়ার হ্যাঁ-না ভোট আরও আগের ঘটনা, পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সময় দিয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগকে সময় দিলে ক্ষতি কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : জিয়াউর রহমান জনগণের কাছে গিয়ে ভোট চেয়েছিলেন। এরশাদও গেছেন। তাঁরা যদি জনগণকে সেই সুযোগটা দিয়ে অগ্রসর হতেন তাহলেও তো একটা কথা ছিল, সেটাও তো নয়।
প্রথম আলো : বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে ভুল করেনি?
এমাজউদ্দীন আহমদ : প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন নির্বাচনটা বাধ্যবাধকতার জন্য করছি। একাদশের জন্য আমরা আলোচনা করব। নির্বাচন বর্জন ভুল হবে কেন। আওয়ামী লীগের দাবিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়েছিল।
প্রথম আলো : জিয়ার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়নি। বিএনপির অধীনে আওয়ামী লীগ ভোটে গেছে। এখন বিএনপি পারবে না কেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : পারবে না, তার কারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অপরিহার্য, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আমলাতন্ত্র, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় দলীয়করণের মাত্রা চোখে পড়ছে না? ইকোনমিস্ট বলেছে, বাংলাদেশের রাজনীতি বিষাক্ত হয়ে গেছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দলীয়করণকৃত ও বিকৃত হয়েছে।
প্রথম আলো : তাহলে বিএনপির পক্ষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর নির্বাচন করা সম্ভব নয়?
এমাজউদ্দীন আহমদ : না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, কথা সেটা নয়। আমি বিএনপির পক্ষে কথা বলছি না। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে আমার বক্তব্য হলো, দেশে যখন এ রকম সংকট বিদ্যমান, তখন সংলাপ ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ আছে কি?
প্রথম আলো : আপনি কি এই ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে সংলাপে বসলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও নির্বাচনে যেতে রাজি হতে পারে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : তা তো বটেই। অর্থপূর্ণ সংলাপ করতে হলে উভয় পক্ষকেই খানিকটা ছাড় দিতে হবে।
প্রথম আলো : আপনার সুপারিশের অংশ হিসেবে বিএনপি যদি এখনই শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার একটি ইঙ্গিত দেয়, তাহলে কি রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমন বা আওয়ামী লীগকে আলোচনার টেবিলে আনতে সেটা সহায়ক হতে পারে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : বলেছেন ঠিকই। বিএনপি যদি এ রকম কোনো বক্তব্য দেয়, সেখানে দুটো কথা থাকতে হবে। প্রথমত, নির্বাচনটা যাতে সুষ্ঠু হয়, দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্দলীয় হতে হবে তা আমি বলছি না, কিছুদিন আগে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় যেমনটা হলো।
প্রথম আলো : তার মানে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ঠিক তাঁকে রেখেই। এ রকম একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতেই পারে। এবং সেটা স্বচ্ছন্দে হতে পারে। সে কারণেই আমি বলি দুই পক্ষকেই খানিকটা ছাড় দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে।
প্রথম আলো : নির্বাচন যখনই হোক, এ রকম একটি আগাম বোঝাপড়ার জন্য দুই পক্ষই লিখিতভাবে এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে পৃথক বিবৃতি দিতে পারে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সেটা তারা পারে।
প্রথম আলো : কে আগে করবে, সেটা নিয়ে তো গোল বাঁধতে পারে। এটা নিরসনে নাগরিক সমাজের কোনো উদ্যোগকে কি বেশি সহায়ক মনে হয়?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সেটা সব থেকে উত্তম। ৫ থেকে ১০ জন একত্র হতে পারেন। তবে আগে এ নিয়ে দুই নেত্রীর সঙ্গে আগাম সলাপরামর্শ করতে হবে। তাঁরা বলবেন আমরা একটি সংলাপ চাই। আপনারা রাজি থাকলে আমরা উদ্যোগ নিতে পারি। যাঁরা শ্রদ্ধেয় আছেন তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে পারেন। এ রকম একটি বোঝাপড়ার কথা শোনার জন্য দুই দলেই বহু যোগ্য ব্যক্তি আছেন। প্রধানমন্ত্রীকে রেখে একটি সমঝোতার চেষ্টা হতে পারে।
প্রথম আলো : কিন্তু তেমন পরিবেশ সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তারেক রহমানের কটূক্তির মতো কিছু বিষয় অনেকে বাধা মনে করেন। ওই কটূক্তি সমর্থনযোগ্য?
এমাজউদ্দীন আহমদ : না। একটা তরুণ ছেলে, যখন তার বাবা সম্পর্কে বলা হলো যে তিনি পাকিস্তানের চর বা ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা, বা রাজাকার—এমন একটি প্রেক্ষাপটেই তিনি আসলে বলেছেন। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে দেখার সূচনা হওয়া উচিত। এখানেও একটি সমঝোতা সৃষ্টিতে জ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা সক্রিয় হতে পারেন। তখন তিনি (তারেক) তাঁদের সিদ্ধান্ত মানতে অযুক্তিসংগত মনোভাব দেখাবেন বলে আশা করি না। জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে তিনি তাঁর ওই অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেন।
প্রথম আলো : বিএনপি ভারতের সহায়তা চেয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।
এমাজউদ্দীন আহমদ : কেবল ভারত বলব না, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিএনপির সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার প্রতি একটা সমর্থন আছে।
প্রথম আলো : বিজেপির মনোভাব ইতিবাচক?
এমাজউদ্দীন আহমদ : বিজেপি সরকারের মনোভাব নেতিবাচক মনে হয়নি।
প্রথম আলো : মিডিয়ার স্বাধীনতাকে কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সংবাদপত্রের কণ্ঠ যদি রুদ্ধ করা হয় তাহলে আর ওই মুখে গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না।
প্রথম আলো : অব্যাহত অবরোধেও সংলাপ নিশ্চিত না–ও হতে পারে। আবার সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপি অবরোধ আরও প্রলম্বিত করতে না–ও পারে। মোট কথা অবরোধ বিএনপির একমাত্র বিকল্প কি না?
এমাজউদ্দীন আহমদ : আমি অন্য বিকল্প দেখি না। তবে আগেই যেমনটা বলেছি, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের মতো একটা কিছু শেষ পর্যায়ে থাকতে পারে। বিএনপির দুর্বলতা আছে। তার বিপুল জনপ্রিয়তাও স্পষ্ট। তবে রাজনীতিকেরা মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে প্রাণ পাওয়া বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত করে কেবল বক্তৃতা দেওয়ার রাজনীতি থেকে বিরত হবেন—আমি অন্তত এতটুকু আশাবাদ শেষ মুহূর্তে পোষণ করতে চাই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ
এমাজউদ্দীন আহমদ : ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment