http://anandabazar-unicode.appspot.com/proxy?p=archive/1081122/22south4.htm কবিগান দর্শক-শ্রোতার 'সরকার'মদন সরকার |
জেঠামশাই মোক্তারি ছেড়ে দিয়ে দেশবিদেশে কবিগান করে বেড়াতেন। জেঠামশাইয়ের নাম বিজয়নারায়ণ আচার্য। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের অন্যতম কবিয়াল। নেত্রকোনা কোর্টে তিনি মোক্তারি করতেন। এই পেশায় অবশ্য তেমন যশ করতে পারেননি। কবিগান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। শশীমোহন আচার্য আমার বাবা। আমার জন্ম ১৩২৪ সালের আশ্বিন মাসে সহিলপুর গ্রামে। সহিলপুর গ্রামটি নেত্রকোনা জেলার সদর থানার সিংহের বাংলা ইউনিয়নে। আমার পুরো নাম মদনমোহন আচার্য। কেউ ডাকে মদন আচার্য, কেউ বলে মদন ঠাকুর, আর কেউ বা কয় মদন সরকার। মদন সরকারই বেশি ডাকে। আমার আর একটি নাম আছে। পাবার দেওয়া। ইন্দুভূষণ আচার্য। এ নামে আমাকে কেউ চেনে না, এ নামে কেউ ডাকেও না। নাম বদলের একটি কাহিনি আছে। আমার জন্মসালে নেত্রকোনায় কবিগান গাইতে এলেন বরিশালের মদন শীল। তিনিও পূর্ববঙ্গের খ্যাতিমান কবিয়াল ছিলেন। আসরে কবির লড়াই বেঁধে গেল আমার জেঠা বিজয় আচার্যের সঙ্গে। সে লড়াইয়ে মদন শীলকে হারিয়ে বিজয় আচার্য সোনার মেডেল পেলেন। আনন্দে তিনি আত্মহারা। বাড়ি ফিরে দেখলেন আমার জন্ম হয়েছে। আনন্দে তিনি মদন শীলের নামের সঙ্গে মিল রেখে আমার নাম রাখলেন মদনমোহন আচার্য। বাবার দেওয়া নাম ইন্দুভূষণ স্কুলের কাগজপত্রেই রয়ে গেল। জেঠামশাইয়ের দেওয়া নামেই সবাই ডাকে। সহজে ডাকার জন্য অনেকে আমার নামের মোহনটা ছেড়ে দিয়ে শুধু মদন আচার্য বলে। আমি ব্রাহ্মণ বলে অনেকে মদন ঠাকুর বলে ডাকে। কবিগান গাইতে যেয়ে আমি কায়স্থের পদবি সরকার পেলাম। হলাম মদন সরকার। সরকার কায়স্থের পদবি হলেও কবিগানের 'সরকার' আলাদা পদবি। যারা কবিগান গাইত তাদেরই দর্শক-শ্রোতারা সম্মান করে 'সরকার' বলে সম্বোধন করত। ব্রাহ্মণ হয়েও 'সরকার' পদবিতে আমার মন্দ লাগে না। ভালোই লাগে। 'সরকার' তো দর্শক-শ্রোতাদের সম্মানের ডাক। এখন বয়স আমার ৯২ বছর। শরীর আর চলে না। কথা বলতেও কষ্ট হয়। বাড়িতে বসে কেবল মনে মনে সুর ভাঁজি। পুরোনো দিনের কথা মনে করি। আনন্দময় দিনের কথা ভাবি। কবিগানের সেই স্বর্ণযুগের কথা ভাবি। তখন আমার যৌবন ছিল। এখন আমি জীবনের শেষের দিকে। এখন—'শুভ্র বরণ করলাম ধারণ,/দাড়ি গোঁফে চুলে,/কেবল পান সুপারি মুলামুড়ি,/দন্তের অন্তকালে।/এখন আর যাই না লঙ্কা,/কাকলী হয়েছে বঙ্কা,/সমন রাজা বাজায় ডঙ্কা,/এ বুড়াকে ধরবে বলে।/সুখ গেল সরিয়া,/অন্ধকারে চলাফেরা,/পরের হাতে ধরিয়া।/শ্বাস ঘনঘন, কাশ ঘনঘন,/তব পদে নিবেদন করি পুনঃ পুনঃ,/যে তা-তা-তা বলে যেতে পারি মরিয়া।' পড়ালেখা বেশি করিনি। আটপাড়া থানার অভয়পাশা স্কুলে পড়েছি। তখন বড় বোনের বাড়ি রামেশ্বরপুর গ্রামে থাকতাম। অভয়পাশা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পড়া শেষ করে নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখানে দুই-তিন ক্লাস পড়েছি। লেখাপড়ায় মন বসে না। শুধু জেঠামশাইয়ের কবিগান আমাকে টানে। সেই টান এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। আমি ভেতরে ভেতরে তাও টের পাই তখন। কবিয়াল হিসেবে জেঠামশাইয়ের নাম তখন দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমিও কবিগানের নেশার প্রবল ঘোরে জেঠামশাইয়ের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াই। কবিগান শুনি রামু, রামগতি, রামদয়ালের মতো বড় বড় কবিয়ালের। মাঝে মাঝে আসরে উঠতাম জেঠামশাইয়ের আশীর্বাদে। তাঁর সুবাদে সম্মানও ভালো পেতাম। দিনে দিনে কবিগানে পাকা হতে লাগলাম। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী পড়ে তত্ত্বকথার সন্ধান করতাম। আমার সমসাময়িক সঙ্গী পেলাম সাধু সরকার, কালী ধর, ক্ষেত্রমোহনসহ আরও অনেককে। তাঁদের অনেকের নাম আজ আর মনে করতে পারি না। আমি ওস্তাদ কবিয়াল রামসুন্দরের কাছে দীর্ঘদিন পাঠ নিয়েছি। ১৮ বছর বয়সে আমরা ঘুরতে শুরু করেছি সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, গৌরীপুর, মুক্তাগাছা। অনেক জমিদারবাড়িতে কবিগান করেছি। সে সময় কবিগান শুনতেন জমিদার-নায়েবসহ সমাজের বড় বড় মানুষ। হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে কবিগান শুনত। আমার দলের খুব নামডাক ছিল। আমরা কয়েকজন কবি সরকার কথা দিয়ে কথা কেটে আসর জমাতাম। 'হিন্দু আনি, মুসলমানি, করতাম আমরা টানাটানি।' কখনো হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করে আমরা চিন্তা করিনি। সম্প্রীতি বজায় রাখতাম। ধর্ম যা-ই হোক, সবাই মানুষ। এই বোধ সবার মধ্যে ছিল। আমরা ভাবতাম: 'পাখির দুটি পাখাই সমান,/তদ্রূপ হিন্দু-মুসলমান।/এক পাখা কাটলে পরে,/পাখি কি আর উড়তে পারে।/পাখাহীন পাখির থাকে না পরান।' শ্রোতারা বসে কবিগান শুনত। টপ্পা চলত যুক্তি দিয়ে, শব্দের ছন্দ দিয়ে। যুক্তি শুনে দর্শকশ্রোতা হাততালি দিত। নিজেকে তখন জমিদার মনে হতো। সে সময় কবিয়ালের সম্মান ছিল, কদর ছিল। এখন নেই। সময় বদলে গেছে। দেখতে দেখতে পাল্টে গেল অনেক কিছু। কিন্তু আমাদের নিজস্ব সম্পদ কবিগানের দুর্দশা কাটল না। 'ব্রিটিশ রাজ্যের অবসান,/জিন্না আনল পাকিস্তান,/রাখল দেশের গৌরবমান/মূর্তি-মন্ত হইয়া,/ও তার ভাবলীলা অবসান,/রাজ্য ছাড়ল আইয়ুব খান,/দিনে দিনে টিক্কা, ইয়াহিয়া।/বহু সংগ্রাম করে শেষ,/শেখ আনল বাংলাদেশ,/শান্তি সুখে ছিলাম বেশ।/দেশবাসী যত,/আতাতায়ী যত ঢুকে পড়ে,/যেনতেন প্রাণে মারে।/আরো সকল সহকারে/ দুঃখ দিয়া কত।' কবিগান তো আর সারা বছর চলত না। তাই সংসার টানতে অন্য কাজও করেছি। কবিগানের পাশাপাশি পিতল, কাঁসার বাসনপত্রে খোদাই করে নাম লিখতাম। হরফপ্রতি আট আনা পেতাম। সে পয়সা সংসারের কাজে আসত। এ কাজটি আমি শিল্প হিসেবে মনে করতাম। দেখতে দেখতে অনেক কাল গড়িয়ে গেছে। গঙ্গা-পদ্মায় অনেক জল গড়িয়েছে। দর্শক-শ্রোতাদের রুচির বদল হয়েছে। ভাবের বদল হয়েছে। টাকার দরকার আমারও ছিল। তখন তা বুঝিনি। এখন সন্ধ্যাকালে বুঝি। এখন বুঝলেই কি, আর না বুঝলেই কি? সময়ের কাজ সময়ে করিনি। তবে তার জন্য কোনো খেদ নেই। টাকার দিকে তাকাইনি। আমি গান চাইছি। তাই দিয়েই আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। 'হঠাৎ করে আইল ধন,/টাকার ভিতরে এত গুণ,/নির্দোষী হয় করিয়া খুন,/টাকার ভিতর দিয়া।/লোকে একটা কথা বলে,/পুত্রশোক টাকা ভুলে।/যত ইতি কর্ম চলে,/হাতের টাকা দিয়া।/টাকা জানি পরমার্থ,/টাকাহীনের জনম ব্যর্থ।/জনসমাজে অপদার্থ,/স্বার্থ কি আর বেচে।/ধার-কর্জ কেউ চাইলে দেয় না,/খাইছে কিনা খবর নেয় না।/গরিবের দায় এ যাতনা,/জীবন ভরা আছে।' শিল্পী হিসেবে দেশের মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কবি হিসেবে সম্মান পেয়েছি। সরকারের খাতায়ও আমার নাম আছে। সরকার আমায় বছরে ছয় হাজার টাকা ভাতা দেয়। হোক কম, তবু সরকারের সম্মানী! এটি আমার জন্য গৌরবের। নিজের আর কোনো আয় নেই। ছেলের আয়েই জীবন বাঁচাই। গ্রামের বাজারে ডাক্তারি করে আমার ছেলে রবীন্দ্র আচার্য। যা পায় তা দিয়ে তার ছেলেমেয়েসহ আমাকে নিয়ে কোনোক্রমে দিন চালায়। আমার স্ত্রী লাবণ্য বালা গত হয়েছে কয়েক বছর আগে। দুই মেয়ে শোভা ও বিভার বিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। সন-তারিখ মনে নেই। বিভা রামমঙ্গল গায়। কীর্তনের দল আছে তাঁর। এ দিয়ে সে সংসার চালায়। আমরা কেউ ভালো নেই। একবার আহার আরেকবার অনাহারে দিন চলে। শুধু অতীত মনে হয়। কী ছিলাম, এখন কী হলাম! 'এখন দল নাই,/ডুলি নাই।/বিপক্ষের সরকার নাই,/আমারে আর দরকার নাই।' এখন পারের আশায় বসে আছি। কখন তাঁর ডাক পাই—তখন তাঁর কাছে চলে যাব। আমার গাওয়া গান শুনে যে মানুষেরা খুশি হতো, তাদের কাছে থেকে যাবে আমার কবিতা, আমার গান, গানের সুর। এ ভেবেই মনে আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই। জীবনটাকে সার্থক ভাবি। অনুলিখন: আলী আহাম্মদ খান বাংলা সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে পোস্টের রিভিউ (দ্বিতীয়) ০৩ রা আগস্ট, ২০০৮ দুপুর ১২:০৪ তপন বাগচী বলেছেন: মনোমোহন দত্ত (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মলয়া সঙ্গীত বিজয় সরকার (নড়াইল), কবিগান, বিচ্ছেদী গান রমেশ শীল (চট্টগ্রাম), কবিগান, মাইজভাণ্ডারী গান প্রফুল্ল গোঁসাই (প্রফুল্লরঞ্জন বিশ্বাস, নড়াইল), বৈঠকী গান মোসলেম বয়াতী (নড়াইল), জারিগান গনি বয়াতী (বরিশাল), জারিগান পাগলা কানাই (ঝিনাইদহ), ধুয়াগান, জারিগান কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (কুষ্টিয়া), বাউলগান মহিন শাহ (ফরিদপুর), বাউলগান জসীমউদদীন (ফরিদপুর), পল্লীগিতি, ভাটিয়ালী মেছের শাহ (ফরিদপুর), মুর্শিদিগান চণ্ডী গোঁসাই (গোপালগঞ্জ), বৈঠকীগান রবীন্দ্রনাথ মিশ্র (কুড়িগ্রাম), ভাওয়াইয়াগান নীলকমল (কুড়িগ্রাম), ভাওয়াইয়াগান ভূপতিভূষণ বর্মা (কুড়িগ্রাম), ভাওয়াইয়াগান আবদুল হালিম বয়াতী (মাদারীপুর), ভাবগান ও বিচারগান গীতা দত্ত আভা আলম সঞ্জীব চৌধুরী..... হরিচারণ আচার্য, কবিগান রাজেন সরকার, কবিগান তারক সরকার, কবিগান অনাদিজ্ঞান সরকার, কবিগান মনোহর ঠাকুর, বৈঠকীগান মহসিন হোসাইন, কবিগান ও লোকসঙ্গীত গবেষক অশ্বিনী গোঁসাই, মতুয়া সঙ্গীত সুকণ্ঠ গাইন, রামায়ণগান................ মনে পড়লে আবার লিখব..... কানা বাবা বলেছেন: গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার দেবু ভট্টাচার্য্য কার্তিক দাস বাউল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আনোয়ারউদ্দিন খান নজরুল ইসলাম বাবু পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় নকিব খান লোপামুদ্রা মিত্র জীবনানন্দ দাশ, জয় গোস্বামী, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী প্রোমুখ কবির কোবতেগুলানে সুর দিয়া মচেৎকার গান বানাইচিলো হ্যায়... 'বেণীমাধব', 'আবার আসিবো ফিরে' গানগুলানতো তো পুরা জুশ... লোপামুদ্রার ওয়েবলিন্ক মৌসুমী ভৌমিকের লিরিক্সগুলানও ভালা... সেলিম তাহের বলেছেন: জালাল উদ্দিন খান ( জালাল গীতিকা)
মুজিব মেহদী বলেছেন: লালন শীতালং শাহ পাগলা কানাই দেওয়ান রশিদ দুদ্দু শাহ নেধু শাহ শাহ আরকুম পাঞ্জু শাহ হাছন রাজা রাধারমণ শাহ আবদুল করিম রশিদউদ্দিন জালালউদ্দিন খাঁ দ্বিজদাস দীন শরৎ হরিচরণ আচার্য আজাহার বয়াতী রমেশ শীল মুকুন্দ দাস মনোমোহন দত্ত লাল মামুদ সুলা গাইন বিজয় নারায়ণ আচার্য কানাইলাল শীল রামগতি শীল রামকানাই নাথ নিবারণ পণ্ডিত ভবা পাগলা উকিল মুনসি চান খাঁ পাঠান তৈয়ব আলী মিরাজ আলী দুলু খাঁ আবেদ খাঁ উমেদ আলী আবদুল মজিদ তালুকদার আবদুস সাত্তার ইদ্রিছ মিয়া আলী হোসেন সরকার গুল মাহমুদ প্রভাত সূত্রধর আবদুল হেকিম সরকার
মূল পোস্ট লালন ফকির হাসন রাজা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডি এল রায় রজনী কান্ত সেন অতুল প্রসাদ কাজী নজরুল ইসলাম উকিল মুন্সি শাহ আব্দুল করিম খান আতাইর রহমান আবু হেনা মোস্তফা কামাল জসীম উদ্দিন আব্দুল আলীম শচীন দেব বর্মন মাহমুদুন নবী আব্বাস উদ্দিন সলিল চৌধুরী প্রতুল মুখোপাধ্যায় আব্দুল জব্বার কাঙালিনি সুফিয়া ভুপেন হাজারিকা লাকি আকন্দ শেফালী ঘোষ আব্দুর রহমান বয়াতি রাধা রমণ সুধীন দাস ...... যোগ করুন আপনার প্রিয় এবং জানা তালিকা... http://www.somewhereinblog.net/blog/Bashpo/28826864 নববর্ষ সংখ্যা ১৪১৭ মুখবন্ধসাজ্জাদ শরিফ শাস্ত্র হিসেবে নৃতত্ত্ব কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর প্রশ্নটা তুলেছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিকই, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা সমাজগুলোর পর্যবেক্ষণকে কেন বলা হবে নৃতত্ত্ব, আর ধনী সমাজের পর্যবেক্ষণকে কেন আমরা বলব সমাজতত্ত্ব? এরপর নৃতত্ত্ব আর আগের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। একটু ঘুরিয়ে এখানেও এ প্রশ্ন তোলা যায়, শিক্ষিত সমাজের সৃজনশীল প্রকাশকে যেখানে আমরা ডাকি 'শিল্প' বলে, সেখানে আনপড় সমাজের সংস্কৃতিকে কেন বলা হবে 'লোকশিল্প'? নানাজনের লেখাপত্র থেকে 'লোকশিল্প' সম্পর্কে মোটা দাগে যে ধারণা মেলে তা অনেকটা এ রকম: 'লোকশিল্পে'র ভাষা স্থির। কারণ এর ভাষাটির সুনির্দিষ্ট একটি ধারণা আনপড় সমাজে আগে থেকেই হাজির থাকে। ব্যক্তিশিল্পী সেই সামাজিক ভাষাটিতে নিজের সৃজনশীলতা রূপায়ণ করেন। আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা ভাষায় আত্মাহুতি দেন ব্যক্তিশিল্পী। অর্থাৎ আমাদের লোকায়ত শিল্পচর্চার পুরো ঘটনাটি যেন ইতিহাসের বাইরের ঘটনা। সময় পাল্টাচ্ছে, কিন্তু শিল্পের ভাষা ও অভিজ্ঞতা পাল্টাচ্ছে না। বিষয়টি একটু বিশদ করা যাক। আমরা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, সৃষ্টিশীল ধারণা ও ভাষার অভিনবত্বে আধুনিক শিল্পীরা আমাদের যারপরনাই হতচকিত করে তুলছেন। অথচ গ্রামেগঞ্জে যাঁরা গাজীর পট আঁঁকছেন, যুগের পর যুগ তাঁদের অঙ্কনশৈলীতে চোখে ধরা পড়ার মতো বদল ঘটছে কোথায়? এ থেকে চটজলদি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আমাদের দেরি হয় না যে, নতুন যুগের মার্জিত শিল্পকলা যেখানে সমসাময়িক ইতিহাসের হাত ধরে উঠে এসেছে, 'লোকশিল্প' সেখানে পড়ে রয়েছে পেছনে। এ শিল্পকলা বিলীয়মান অতীতের স্মৃতিচারণ মাত্র। এর মূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক। এ শিল্পের পেছনে কাজ করছে একটি পিছিয়ে থাকা বা পশ্চাদ্পদ সমাজের মন। আমাদের সচল জীবনে এর কোনো যোগ নেই। 'লোকশিল্পে'র প্রতি আমাদের দরদ আছে বটে, তবে সেটা জাতীয়তাবাদী আবেগে, জাতির 'শেকড়' খোঁজার অন্বেষায়। বলছিলাম আনপড় পশ্চাদ্পদ সমাজের মনের কথা, তাদের পিছিয়ে থাকা শিল্পকলার কথা। এই ধারণারই গোড়ায় আঘাত করেছিলেন ফরাসি ভাবুক ক্লদ লেভি-স্ত্রস। মিথ অ্যান্ড মিনিং বইয়ে তিনি বললেন, এ সমাজকে পশ্চাদ্পদ ভাবার লেশমাত্র অবকাশ নেই, কারণ 'চারপাশের জগত, এর প্রকৃতি এবং নিজেদের সমাজকে বোঝার তাগিদে ও কামনায় এঁরাও উদ্গ্রীব। এ কারণে একেবারে দার্শনিক, এমনকি কখনো কখনো বিজ্ঞানীদের মতো, এঁরাও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে এগিয়ে চলেন।' ক্লদ এখানেই থামেন না। শিক্ষিত ও আনপড় সমাজের পার্থক্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, লোকায়ত সমাজ 'আলাদা কারণ এঁরা স্বল্পতম রসদ নিয়ে বিশ্বজগত সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণায় পৌঁছাতে চান—আর এ ধারণা নিছক সাধারণ নয়, বরং সামগ্রিক।' (বাঁকা হরফ ক্লদ লেভি-স্ত্রসের)। জগদ্বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের দোহাই দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষিত সমাজের বৈজ্ঞানিক মন এর বিপরীত। নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য সবকিছু তাঁরা বিভক্ত করে আনে। সহজ কথায়, আনপড় সমাজের বিশ্বরূপ অখণ্ড, আধুনিক সমাজের বিশ্বধারণা বিচূর্ণ। তাঁদের নিজ নিজ শিল্পকলায়ও সেই বিশ্বরূপেরই অভিব্যক্তি। এই ধারণার চাক্ষুস নমুনা দেখেছিলাম জাপানের এক লোকশিল্প জাদুঘরের চত্বরে পা রাখার পর। কামরার পর কামরায় বিপুলায়তন সে জাদুঘরে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এমন সব লোকায়ত শিল্পের নিদর্শন, যা রচিত হয়েছে কেবল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোয়। ইতিহাসের সেসব ব্রাহ্মমুহূর্ত কীভাবে ভেঙে দিচ্ছে 'লোকশিল্পে'র তথাকথিত চেনা ছক, সে ছিল অবাক বিস্ময়ে দেখার মতো ব্যাপার। শিল্পরচনার প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ শিল্পীর লড়াই বরং আরও তীব্র। গ্রামসমাজের মানসে গেঁথে থাকা শিল্পভাষাটি তৃপ্ত করে শুরু করতে হয় তাঁদের শিল্পরচনা। কিন্তু আবার ওরই মধ্যে রূপায়ণ করতে হয় শিল্পীর নিজস্ব শিল্পচেতনা। সমাজের কাঙ্ক্ষিত শিল্পভাষার মধ্যে তাই সেখানে স্ফূর্তি ঘটে ব্যক্তিশিল্পীর নিজস্ব মুদ্রা ও পাল্টে যাওয়া বিশ্ববোধ। ইতিহাসের দীর্ঘ পটভূমিকায় এই বিবর্তন এত ধীর ও সূক্ষ্ম যে ধৈর্যের সঙ্গে লক্ষ না করলে সহজে নজরে আসে না। বাংলাদেশের লোকায়তিক শিল্পের নিবিড় পর্যবেক্ষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক হেনরি গ্লাসির বর্ণনায়, এ শিল্প 'ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক, বৌদ্ধিক ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ, উদ্ভাবনমুখর ও চিরায়ত, বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক, প্রয়োজনীয় ও মনোহর, ইচ্ছা ও বাস্তবতার এক সমন্বয়।' আমাদের লোকায়ত শিল্পেও এভাবে রচিত হয়ে চলেছে বাংলার নিজস্ব ও অখণ্ড বিশ্বরূপ। আর গ্রামেগঞ্জে তা রচনা করে চলেছেন আমাদের প্রজ্ঞাবান শিল্পীরা; যাত্রায়, পটে, মৃত্ ও ধাতুশিল্পে, গানের বিচিত্র উচ্ছৃত ধারায়। জাতি হিসেবে আমাদের স্বপ্ন ও লড়াইয়ের খবর পেতে হলে এ শিল্পেরই কাছে আমাদের বারবার ফিরে ফিরে আসতে হবে। বাউলগানআবদুল করিম শাহ আমার বয়স এখন প্রায় চার কুড়ি দশ। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। সাঁইজির কথায় বলতে গেলে: দিনে দিনে হলো আমার দিন আখেরি \ আমি ছিলাম কোথা এলাম কোথা আবার যাব কোথা সদাই ভেবে মরি \ বাল্যকাল খেলায় গেল যৌবনে কলঙ্ক হলো বৃদ্ধকাল সামনে এলো মহাকাল এসে করলো অধিকারী \ এই তো অবস্থা! পারঘাটায় বসে আছি—কখন দয়ালচাঁদের নাও আসে সেই আশায়। আকুল হয়ে ডাকছি কখন তাঁর কৃপা হয়: পারে লয়ে যাও আমায়। আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময় \ নাই আমার ভজনসাধন চিরদিন কুপথে গমন নাম শুনেছি পতিতপাবন তাইতে দেই দোহাই \ আমি একা রইলাম ঘাটে ভানু সে বসিল পাটে তোমা বিনে ঘোর সংকটে না দেখি উপায় \ আগেকার নদীয়া জেলা—এখনকার জেলা কুষ্টিয়ার মীরপুর থানার অধীন অঞ্জনগাছি গ্রামে আমার জন্ম। মায়ের কাছে শুনেছি, বাংলা ১৩২৭ সনের ভাদ্র মাসে যে-বার বড় বন্যা সব গ্রামগঞ্জ ভাসিয়ে নিয়েছিল, সেই মহাদুর্যোগের কালে আমি হই। আমার বাপের নাম ঝুমুর আলী আর মায়ের নাম কুসুম। আমরা 'জোয়ারদার' বংশের লোক। জায়গাজমি বেশ ভালোই ছিল। আমরা ছিলাম সম্পন্ন গেরস্ত। বাপজান ঝুমুর আলী কৃষিকর্ম করতেন। পাশাপাশি গানবাজনাও ভালোবাসতেন। আর আমাদের অঞ্জনগাছি গ্রাম ছিল গানের গ্রাম। যাত্রাপালা, ভাসান, ধুয়োজারি, পদ্মাপুরাণ, গাজীর গীত—এসব গান হামেশাই হতো। সারা বছরই গানের আসর লেগে থাকত। তবে ফসল ওঠার পর চাষি-গেরস্তের কাজকামের অবসর মিলত, তখন জাঁকিয়ে এসব গানের আসর-বাসর বসত। তখন উৎসব-আনন্দে গ্রামের চেহারাটাই বদলে যেত। বাপজান ঝুমুর আলীর অন্তরে এক ধরনের উদাস ভাব ছিল—সেই কারণে বাপ-মা দুজনই কুষ্টিয়া শহরের কোলে উদিবাড়ী গ্রামের চিশতিয়া তরিকায় সাধক মনসুর শাহের কাছে দীক্ষা নেন। আর সেই সঙ্গে ছিল গান-বাজনার ঝোঁকও। ভাবগানের পাল্লায় অংশ নিতে গ্রামের বাইরেও নানা জায়গায় ডাক পড়ত তাঁর। পাল্লার গানে বাপজানের বেশ নাম-যশও ছিল। আমার মা-ও কিন্তু শুনে শুনে গান তুলতে পারতেন—গলাও ছিল বেশ ভালো। কিন্তু সেই সুর ওই বাড়ির ভেতরেই ঘোরাফেরা করত। একটু বড় হয়ে বাপজানের সঙ্গে গানের আসরে যাওয়া শুরু করলাম। তাঁর গানের সঙ্গে জুড়ি বাজাতাম। এ রকম করে গানের ওপর খুব মন বসে গেল। বলতে গেলে বাপজানই আমার গানের প্রথম গুরু—তাঁর কাছেই এ বিদ্যের হাতেখড়ি। অঞ্জনগাছি সেই সময়ে ছিল ছবির মতো গ্রাম। এর পাশ দিয়ে বয়ে যেত পারুল নামের ছোট্ট একটি নদী। অবশ্য এখন আর সেই নদী নেই—হেজেমজে শেষ হয়ে গেছে। তার ওপরে এখন ফসলের মাঠ। তো সেই পারুল নদী আমাকে খুব টানত। রোজই প্রায় পারুল নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম আর গুনগুন করে গান গাইতাম। এভাবে ধীরে ধীরে কখন যেন গানের মোহ আমাকে টেনে নিয়ে গেল ভিন্ন এক জগতে। এই অঞ্জনগাছি গ্রামেরই আবুল মকসুদ—সম্পর্কে আমার জ্ঞাতি-ফুপা—শব্দগানের ওস্তাদ গায়ক ছিলেন। তিনিই আমাকে হাতে ধরে ভাবগানের তালিম দেন। তখন থেকেই মনটা উড়ু উড়ু। গানের নেশায় ঘর ছাড়লাম সেই ১৬-১৭ বছর বয়সেই। গেলাম কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার জগন্নাথপুরের তছের শাহ ফকিরের কাছে। বলা যায়, তছের শাহ ফকিরি গান শেখার কপিন এঁটে দিলেন ভালো করে। বেশ কিছুকাল ছিলাম তাঁর কাছে। তারপর এলাম ফকির বেহাল শাহের দ্বারে। তাঁর নিবাস ছিল আলমডাঙ্গা থানার ফরিদপুর গ্রামে। এখানে একনাগাড়ে থাকি বেশ কয়েক বছর। বেহাল শাহ একেবারে উজাড় করে দিলেন তাঁর গানের ভান্ডার। মহত্-মহাজন সাধু-গুরুর কাছে আমার যা কিছু কদরদানি তার মূলে বেহাল শাহ। এ কথা আমি দশমুখে বলব যে বেহাল শাহই আমার গানের প্রধান গুরু। অবশ্য আরও দু-চারজন সাধু-গুরুর কাছে সামান্য গানের শিক্ষা নিলেও বেহাল শাহই আমার গানের জগতের চক্ষুদানির গুরু। গান তো যা হোক শেখা হলো। ভাবগানের মধ্যে মন ডুবে গেল। এখন সাধনগুরুর খোঁজে পথে নামলাম। আমার বাপ-মা দুজনই বয়েত হয়েছিলেন উদিবাড়ীর মনসুর শাহ ফকিরের কাছে। আমিও প্রথমে এখানেই দাখিল হলাম। তারপর শুরু হলো পথে পথে ঘোরা—সাধুসঙ্গ করি আর পড়ে থাকি আখড়ায় আখড়ায়। মনটা শা হয় না। সব সময়ই মন কী যেন খুঁজে বেড়ায়। তখন আমার উঠতি বয়স—এই ২৫-২৬ বছর হবে আর কি। অবশেষে মনের মতো গুরুর সন্ধান মিলল সদর কুষ্টিয়ার হালসার কাছে শঙ্করদিয়া গ্রামে ফকির নিমাই শাহের ধামে এসে। নিমাই শাহ ছিলেন সতী মায়ের ঘরের সাধক-ফকির। তাঁর সঙ্গ-সান্নিধ্য আর বাক্য শুনে মনের বন্ধ জানালাগুলো সব খুলে গেল। এক মরমি আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল অন্তরের অন্ধকার ভুবন। দীক্ষা নিলাম তাঁর কাছে। দুনিয়ার ফিকির ছেড়ে হলাম সাধনপথের ফকির। নিমাই শাহের গুরুপরম্পরার পরিচয় এবার নেওয়া যাক। নিমাই শাহের গুরু ছিলেন জেলা যশোরের মহেশপুর থানার নওদাগাঁও বুঝতলার অমূল্য শাহ, তাঁর গুরু কুষ্টিয়ার মীরপুর থানার মল্লিকপুরের পাঁচু শাহ, তাঁর গুরু চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানার বণ্ডবিল গ্রামের খুদু শাহ। খুদু শাহের গুরুর নামও জানতাম—কিন্তু এখন আর মনে পড়ছে না। বাউল-ফকিরের ঘর পাঁচটা: সতী মায়ের ঘর, লালন সাঁইয়ের ঘর, উজল চৌধুরীর ঘর, দেলবার শাহের ঘর আর পাঞ্জু শাহের ঘর। আমরা সতী মায়ের ঘরের ফকির, তবে অন্য ঘরের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক আছে—ভাবের আদান-প্রদান—সাধুসঙ্গ হয়ে থাকে। লালনের ঘরই এখন সবচেয়ে বড় ঘর—তাঁর পদ-পদাবলিই সাধু-গুরু বাউল-ফকিরের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এই যে আমি, সতী মায়ের ঘরের ফকির হলেও প্রধানত লালনের গানই গেয়ে থাকি। সতী মায়ের ঘরের গানেরও অনেক নামকরা গায়ক ছিলেন। ঝিনাইদহের জহরদ্দি শাহ উজল চৌধুরীর ঘরকে আলোকিত করে রেখেছিলেন তাঁর গানের ভেতর দিয়ে। দেলবার শাহের ঘরের গান গাইতেন হালসার আকবর ফকির। পাঞ্জু শাহের গান সাধুমহলে অনেকেই গেয়ে থাকেন। আর লালন সাঁইজির গান তো সব আসর-বাসরে সবাই করে থাকেন। আমি এক ভবঘুরে ফকির। সেই যৌবনকালে ঘর ছেড়েছিলাম, বলতে গেলে এখনো পথে পথেই আছি—স্থায়ী ঠাঁই আর হয়নি। অবশ্য বাউলের আসল ঠিকানা তো সেই আলেক সাঁইয়ের ধাম। তো যা-ই হোক, জন্মগ্রাম অঞ্জনগাছি ছাড়ার পর বহু ঘাটের পানি খেয়ে প্রথমে নীলমণিগঞ্জের কাছে শর্ষেডাঙ্গায় আখড়া গড়ে তুলি। সেখান থেকে যশোরের বাঘারপাড়া থানার নলডাঙ্গা, তারপর যশোরের বারান্দিপাড়ায় প্রায় এক যুগ থাকি। অন্তরের তাগিদে আর গুরুর মায়ায় শঙ্করদিয়ায় গুরুবাড়িতেও কয়েক বছর বাস করি। আবার ফিরে যাই বারান্দিপাড়ায়। তারপর কুষ্টিয়ার চৌড়হাসে কিছুকাল থাকার পর আসি এখন যেখানে আছি— কুমারগাড়ার ক্যানালপাড়ার বস্তিতে। এখানেই একটা আখড়াবাড়ি করে সাধুভক্ত শিষ্য-শাবকদের নিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে চাই। একটা কথা এখানে বলে রাখি। বাউল-ফকিরদের মধ্যে কিন্তু নারী-পুরুষে কোনো বিভেদ নেই। পুরুষ ও প্রকৃতির যুগলসাধনেই তো সেই অধরাকে ধরতে হয়—মনের মানুষকে পাওয়া যায়। নারীর গুরুত্ব ও মর্যাদা তাই বাউলসাধনায় অনেক ওপরে। বাউল-ফকিরদের আদি গুরুও তো মাধব বিবি নামের এক মুসলমান নারী। রাসুল তো তাঁর মারেফতের গুপ্ত জ্ঞান দিয়ে যান বিবি ফাতেমাকে। আমাদের ঘরের ধর্মগুরু সতী মাও তো একজন নারী। ফকিরানি যে নারী-পুরুষ সবাইকেই দীক্ষা দেওয়ার অধিকারী, সে তো আমার নিজের চোখেই দেখা। খোর্দ আইলচারার কালিদাসী ফকিরানি, ফরিদপুর গ্রামের শুকচাঁদ শাহের সেবাদাসী বানু মাতাজি আর কোকিল শাহের সেবাদাসী যশোদা ফকিরানির কাছে দীক্ষা নেওয়া সাধনপথের নারী-পুরুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। জাঁহাপুরের খোদাবক্স শাহই তো শেষকালে বানু মাতাজির কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। আর গানের দলেও তো কোনো কোনো ফকিরানির দাপটের কথা মনে পড়ে—এঁদের মধ্যে কুষ্টিয়া শহরের পাশেই মঙ্গলবাড়িয়ার ননীবালা, সরোজগঞ্জের পাশের বলগাতি গ্রামের সুরধনী আর লাইলি ফকিরানির কথা কি কখনো ভোলা যায়! এই নব্বই বছর বয়সে কত বড় বড় সাধক-মহাজনের সঙ্গ লাভ করেছি, তা ভাবলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। এঁদের বেশির ভাগই আজ আর নেই—একে একে সব বিদায় নিয়েছেন। তাঁরা ভাগ্যবান—তাঁরা সব পরমাত্মায় মিশে গেছেন। সেই পরমগুরু অমূল্য শাহ, নিমাই শাহ, বেহাল শাহ, শুকচাঁদ শাহ, শৈলকূপার বসন্তপুরের কালাচাঁদ শাহ ও আতর আলী শাহ, শালিখা থানার গোয়ালখালীর মহেন্দ্র গোঁসাই, জাঁহাপুরের খোদাবক্স শাহ, মেহেরপুরের যাদবপুরের গোলাম ঝড়ু শাহ, ঝিকরগাছার বাঁকড়ার কানাই শাহ, ঝুটিয়াডাঙ্গার নঈমুদ্দীন শাহ, ঝিকরগাছার কানকুলা চাঁদা গ্রামের গহর শাহ, ছেঁউড়িয়ার গোলাম ইয়াসিন শাহ, মকছেদ আলী শাহ—আরও কত মহত্-মহাজনের নাম মনে পড়ে। এই সেদিন চলে গেলেন খলিসাকুণ্ডির ফকির আবদুর রব শাহ। হায়, তাঁরা আজ কোথায়! আমি অধম-পাপী শুধু পড়ে আছি ভবযন্ত্রণা ভোগ করতে। ভাবি বসে—অন্তিমকালে 'কবে সাধুর চরণধূলি মোর লাগবে গায়'! সাধুসঙ্গের কত স্মৃতি আজ মনের মধ্যে গুমরে ফেরে—কোনোটা আনন্দের, কোনোটা বেদনার। গুরু-শিষ্যের মান-অপমানের একটা ঘটনার কথা বলি। শুকচাঁদ শাহের গুরু ছিলেন অমূল্য শাহ। কিন্তু তিনি গোপনে আবার গুরুপদে দীক্ষা নেন হরিয়ারঘাটের খোদাবক্স শাহের কাছে। তো এই শুকচাঁদ শাহ তাঁর ফরিদপুর গ্রামের আখড়ায় এক সাধুসঙ্গের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই গুরুভক্তির নিদর্শন হিসেবে সেবাসামগ্রীর 'পারস' দিতে হয়। শুকচাঁদ সেই 'পারস' যখন খোদাবক্স শাহের সামনে পেশ করলেন, তখন বিস্মিত-ব্যথিত অমূল্য শাহ মাথা নিচু করে বসে রইলেন আর তাঁর দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সাধুরা শুকচাঁদকে তিরস্কার করে গুরু অমূল্য শাহের কাছে মাফ চাইতে বললেন। অনুতপ্ত শুকচাঁদ গুরুর দুই পা জড়িয়ে ধরে মাফ চাইলে অমূল্য শাহ শুধু বললেন, 'বাবা শুকচাঁদ, যে মানুষটা তোমাকে মাফ করবে, সেই মানুষ তো আর আমার মধ্যে নেই! সে তো কখন চলে গেছে!' এই ঘটনা সাধু-গুরুদের মধ্যে বেশ ক্ষোভের সঞ্চার করে। এর কিছুকাল পরে শুকচাঁদ শাহ তাঁর ভক্তবাড়িতে হঠাৎ দাস্ত-বমি হয়ে দেহত্যাগ করেন। এসব কথা ভাবলে মনটা বড় নরম হয়ে যায়। গুরু যে চোখের মণি—শুকচাঁদ সেই গুরুমাহাত্ম্য বোঝেনি, সে কারণেই এই ঘটনা—সাধুরা তাই মনে করেন। এই জীবনে কত মানুষের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে, সে কথা আর কী বলব! আমেরিকা থেকে এসেছিলেন ক্যারল সলোমন—তাঁর শখ হয়েছিল লালন ও বাউলদের নিয়ে কাজ করার। তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় পয়লা কার্তিক ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁইজির স্মরণোৎসবে। কোন সাল তা আজ আর মনে নেই, তবে বছর তিরিশেক আগে হবে বলে মনে হয়। মেম সাহেব কার কাছে যেন আমার নাম শুনে আমাকে খুঁজে বের করেন। আমার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, 'চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কি'—এই গানটার গোপন মানে কী? তিনি ভেবেছিলেন এটি লালনের গান। আমি তাঁকে বললাম, 'এ তো লালনের গান নয়। এর পদকর্তা বীরভূমের বাউল গোপাল শাহ। আর এসব তত্ত্বকথার আলোচনা তো এখানে হতে পারে না, আমার ঘরে এলে কথাবার্তা হওয়া সম্ভব।' আমি তখন যশোরের বারান্দিপাড়ায় থাকতাম। এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ক্যারল আমার বারান্দিপাড়ায় ভাড়াবাড়িতে এসে উপস্থিত। এই যাত্রায় আমার ওখানে মাস খানেক ছিলেন। বাউলগান ও তত্ত্ব নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল তাঁর, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করতেন। আমিও সাধ্যমতো তাঁর জিজ্ঞাসার জবাব দিতাম—আর মেম সাহেব খাতায় টুকে নিতেন। এর পরও আরও বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে ঢাকা-কুষ্টিয়া-যশোরে। একবার তাঁকে নড়াইলের ডুমদিতে কবিয়াল বিজয় সরকারের বাড়িতে নিয়ে যাই। তিন-চার দিন ছিলেন। অনেক রাত পর্যন্ত নানা তত্ত্ব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। লালনের গানের অনুবাদ ও এই মহেক নিয়ে তিনি কিছু লিখেছিলেন বলে শুনেছি। আমেরিকা থেকে মাঝেমধ্যে চিঠি দিতেন। মেম সাহেবের মনটা বড় সরল ছিল, আর খুব মিশুকও ছিলেন। সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। আমাকে ও ফকিরানিকে খুব ভক্তি করতেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা অনেক সাহায্যও পেয়েছি। একবার আমি কুষ্টিয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেম সাহেব ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এই মানুষটিও প্রায় বছর ঘুরে এল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মানুষের কাছে তো বাউলের ভক্তি-ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই। তবু মিথ্যে বলব না, মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসার পাশাপাশি সাহায্য-সহযোগিতাও কম পাইনি। এই যে ঢাকার বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং আরও অনেকে আমাকে খুব ভালোবাসেন। তাঁদের কথা ভুলব না। সরকার নাকি বাউলদের সাহায্য-টাহায্য করে থাকে বলে শুনেছি, কিন্তু কাজে তো তার প্রমাণ পাইনি। কুষ্টিয়ার শিল্পকলা একাডেমীতে মেন্টর ফেলোশিপে লালনের গান শেখানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ফকির মহিন শাহ। উনি মারা গেলে সেই জায়গায় আমাকে দয়া করে বহাল করা হয়—বছর দেড়েক কাজ করেছিলাম। তারপর আর কেউ ডাকেনি। ১৫-১৬ বছর আগে স্যার (আবুল আহসান চৌধুরী) লালন-শিল্পীদের সঙ্গে আমাকেও কলকাতায় নিয়ে যান। মধুসূদন মঞ্চে আমার গান শোনার জন্য শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায় এসেছিলেন। স্যার কিছুদিন আগে গৌতম ঘোষ নামে কলকাতার এক সিনেমার লোককে নিয়ে এসেছিলেন আমার এই ভাঙা ঘরে। তিনি নাকি লালন সাঁইজিকে নিয়ে সিনেমা করবেন। রাত প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেক গান শোনালাম ফরমায়েশমতো। সিনেমায় লালনের কয়েকটা গান আমাকে দিয়ে গাওয়ানো হবে বলে গৌতম ঘোষ জানালেন। পরে শুনলাম, অন্য গায়ককে দিয়ে তাঁরা গান করিয়েছেন। একবার শুনলাম, সরকার নাকি আমাকে 'একুশে পদক' দেওয়া নিয়ে ভাবছে। ভাবলাম, মরণের আগে হলে তো বেশ ভালোই হয়। কিন্তু কাঙালের ভাগ্যে কি আর শিকে ছেঁড়ে! সাঁইজিই তো বলেছেন: 'সকলি কপালে করে।/ কপালের নাম গোপালচন্দ্র/ কপালের নাম গুয়ে-গোবরে'। সাধুসঙ্গ আর নানা মহতের গান করতে করতে শখ হলো নিজে গান বাঁধার। এ বড় সাহসের কাজ। কোথায় লালন সাঁই, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জ শাহ, জহরদ্দি শাহ, হাউড়ে গোঁসাই, যাদুবিন্দু—আর কোথায় করিম শাহ! এ যেন কুঁজোর কাত হয়ে শোয়ার মতো ব্যাপার। যা-ই হোক, সাঁইজির কৃপায় তা নয় নয় করে ২০-২৫ খানা গান রচনা করেছি—দৈন্য, নবুয়ত, বেলায়েত, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব—এসব আর কি! আসরে-বাসরে দু-একখানা গান গাওয়াও হয়। অধম করিমের একটা দৈন্যপদ বলি: এসো ব্যথার ব্যথিত ওগো তুমি আমার সাঁই। তোমার মতো ব্যথার ব্যথিত ব্রহ্মাণ্ডে কেউ নাই \ দয়াল দরদি হে লুকাইলে কোন্ শহরে অধম রাহা-পানে চেয়ে বঞ্চিত সদাই \ দীনবন্ধু জগত্কর্তা ভুলো না এ অধীনের কথা দরবেশ নিমাই চাঁদ মোর পরম পিতা অধম করিম বলছে তাই \ গান আর গুরু ছাড়া বাউল হয় না। গানই হলো বাউল-ফকিরের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। সাধকের সব ইচ্ছা-আকুতি তো গানের ভেতর দিয়েই প্রকাশ পায়। গানে গানেই তো বাউল তার মনের মানুষকে খোঁজে—স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়ায়। আমিও সেই ভাব নিয়েই গান গাই। গানই আমার জীবন। গান নেই তো আমিও নেই। গান না করলে আমার ভালো লাগে না। আসরে-বাসরে সাধুসঙ্গে তো গাই-ই, এমনই শুয়ে শুয়েও আপন মনে গান করি। গান হলো আমার আত্মার খোরাক। বাউল-ফকিরের এই করণকারণ আর গান-বাজনার জন্য তো কসুরি কম হয়নি। মোল্লা-মৌলবিরা তো গলা টিপে ধরেছে। কিন্তু বাউলের গান তবু থামেনি, থামবে না কখনো। কেননা এই গান 'মানুষ সত্যে'র গান—এই গান কোনো জাত-ধর্মের গান না—এ হলো মানুষকে ভালোবাসার গান। আলেক সাঁই। অনুলিখন: আবুল আহসান চৌধুরী যাত্রা জ্যোৎস্না বিশ্বাস পারিবারিকভাবে কীর্তন গাইতাম ছোটবেলায়। ছিল নাচার অভ্যাস। অভিনয় করার ইচ্ছেও ছিল মনে। তখন অভিনয় কী জানতাম না। জানতাম কেবল সুচিত্রা সেন। তাঁর ছবি দেখেছি। নিজেকে তখন সুচিত্রা সেন ভাবতে শুরু করি। তাঁর মতো শাড়ি পরা, তাঁর মতো কোমরে শাড়ির কোণ গুঁজে দেওয়া, তাঁর ব্লাউজের মতো হাতা বানানো। মনে হতো সুচিত্রা সেন হতে পারলেই বুঝি জীবন সার্থক। কিন্তু সুচিত্রা সেন কীভাবে হওয়া যায়, তার কোনো পথই আমার জানা ছিল না। জন্ম আমার সিরাজগঞ্জে। বাবার নাম গণেশ সূত্রধর, মায়ের নাম এলোকেশী সূত্রধর। তাঁদের আগ্রহেই গানের চর্চা করতাম। আমাদের এলাকা তখন যাত্রাগানের জন্য বিখ্যাত। নারায়ণচন্দ্র দত্ত ১৯৪৪ সাল থেকে যাত্রাদল পরিচালনা করতেন বাসন্তী অপেরা নামে। সারা দেশে নামডাক ছিল ওই দলের। একসময় তিনি দল করা ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তাতে ওই এলাকার যাত্রাগান বন্ধ হয়নি। শখের যাত্রা হতো বিভিন্ন গ্রামে। আমিও শখের যাত্রাদলে গান গেয়েছি, নেচেছি, দু-একটা চরিত্রে অভিনয়ও করেছি। ১৯৫৯ সালে আমাদের গ্রামে বাবুল অপেরা আসে গান গাইতে। আমরা যাত্রা দেখতে যাই। সিরাজদৌলা পালা দেখি। যাত্রায় এলাকা সরগরম হয়ে ওঠে। নারায়ণবাবু আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বাসন্তী অপেরা আবার চালু করেন। বিরাট পোস্টার ছাপালেন 'মেয়ে-পুরুষ সম্মিলিত যাত্রাদল'। এর আগে ছেলেরাই মেয়েদের অভিনয় করত। কেবল বাবুল অপেরায় মঞ্জুশ্রী মুখার্জি এসেছেন চট্টগ্রামের বাবুল থিয়েটার থেকে। মঞ্জুশ্রীদির বাড়ি মাদারীপুরে। কিন্তু তাঁরা চট্টগ্রামেই থাকতেন। তাঁর বাবা খুব বড় যন্ত্রশিল্পী ছিলেন। তো নারায়ণবাবু এসে বাবাকে ধরলেন, 'আপনার মেয়ে তো নাচতে-গাইতে জানে। আমাকে দিন, আমার দলে ওকে নিতে চাই।' আমি বাসন্তী অপেরায় যোগ দিলাম। ওই দলে ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস। তিনি চট্টগ্রামে কমলা থিয়েটার ও বাবুল থিয়েটার থেকে বাবুল অপেরার মাধ্যমে যাত্রাজগতে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি আসেন বাসন্তী অপেরায়। ওই দলে তখন মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস এবং পাবনার অনিল ঘোষ আছেন। আমি সখিনৃত্য করব, এই ভেবেই দলে ঢুকি। কিন্তু একদিন ডিরেক্টর অমলেন্দু বিশ্বাস ডেকে বললেন, 'এই মেয়ে, তুমি অভিনয় করবে।' আমি তো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ি। অত বড় নামকরা ডিরেক্টরের সামনে কথা বলতেই ভয় পাই। মঞ্চে গিয়ে অভিনয় করব কীভাবে? এই ভেবে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়! কিন্তু তিনি সাহস দিলেন। তখন সাহজাদপুরে আমাদের প্যান্ডেল। তিনি ডেকে আমাকে ভাওয়াল সন্ন্যাসী পালায় আশ্রমদুহিতা রত্নাবলীর ভূমিকায় নির্বাচন করেন। দুটি গান ছিল আমার কণ্ঠে। ওস্তাদ যতীন্দ্রমোহন সাহা ছিলেন দলের গানের মাস্টার। তিনি আমাকে গান দুটি শিখিয়ে দিলেন। এমন কোনো যন্ত্র নেই, যা তিনি বাজাতে পারতেন না। খুব গুণী লোক ছিলেন। এমনভাবে গান শেখাতেন যে আমরা সহজেই তুলে নিতে পারতাম। সেই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পী বাঁশরী লাহিড়ী তাঁর ছাত্রী ছিলেন। তিনি এ নিয়ে খুব গর্ব করতেন। এই বাঁশরী লাহিড়ীর ছেলে বাপ্পী লাহিড়ীও খুব নামী শিল্পী হন। যতীন সাহার বন্ধু ছিলেন বারীন মজুমদার। বারীন মজুমদার তাঁকে বড় শিল্পী হিসেবে মান্য করতেন। বারীন মজুমদার ঢাকা এসে তাঁর প্রতিভার সবটুকু উজাড় করে দিলেন। দেশ তাঁকে বরণ করল। কিন্তু ওস্তাদ যতীন সাহা সংগীতজ্ঞ হয়েও সবার কাছে সেই জ্ঞান বিতরণ করতে পারলেন না। আমরা যাত্রার মানুষ এখনো ওস্তাদ যতীন সাহার সংগীত প্রতিভাকে সম্মান করি। তাঁর শেখানো গানের জোরে বুঝি মোটামুটি উতরে গেল। সেই শুরু। একসময় সেই নামকরা ডিরেক্টর অমলেন্দু বিশ্বাস তো আমার জীবনসঙ্গীই হয়ে ওঠেন! আমার সঙ্গে আরেকটি মেয়ে অভিনয়জগতে আসেন—নারায়ণচন্দ্র দত্তের মেয়ে দুলু দত্ত। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সূর্য দত্ত ও তাঁর তিন মেয়ে মায়া দত্ত, ছায়া দত্ত ও জ্যোৎস্না দত্তেরও খুব নামডাক ছিল। সিরাজদৌলায় নায়িকা চরিত্রে ছিলেন শান্তি দেবী। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিকেলে সিদ্ধান্ত হলো, আমাকে ওই চরিত্র করতে হবে। বিশ্বাসবাবুর নির্দেশনায় আমি একবেলা রিহার্সেল করে ওই পরীক্ষায়ও উতরে গেলাম। অনেক দলে অভিনয় করেছি। বাসন্তী অপেরা ছাড়াও বাণীশ্রী, গীতশ্রী, নিউ বাবুল, বুলবুল অপেরায় কাজ করেছি। একসময় এসে গঠন করি চারণিক নাট্যগোষ্ঠী। এটি চারণিক অপেরা, চারণিক সম্প্রদায় নামেও পরিচিতি লাভ করে। বিভিন্ন সময় আমার বিপরীতে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের মধ্যে অমলেন্দু বিশ্বাস ছাড়াও অমূল্য দত্ত, পরিমল সাহা, চিত্তরঞ্জন পাল, শ্যামল মজুমদার প্রমুখ নায়কের কথা মনে পড়ছে। অমলেন্দু বিশ্বাসের সঙ্গেই বেশি অভিনয় করেছি জুটি বেঁধে। ভাওয়াল সন্ন্যাসী পালায় তিনি ছন্দক আমি রত্নাবলী, সিরাজদৌলা পালায় তিনি সিরাজ আমি লুত্ফা কিংবা আলেয়া, মহামতি লেনিন পালায় তিনি লেনিন আমি সাশা পাবলোভা, হিটলার পালায় তিনি হিটলার আমি মারিয়া, মাইকেল মধুসূদন পালায় তিনি মাইকেল আমি দেবকী কিংবা হেনরিয়েটা, সম্রাট জাহান্দার শাহ পালায় তিনি জাহান্দার আমি লালকুমারী, একটি পয়সা পালায় তিনি দিবাকর আমি শর্বরী, পাঁচ পয়সার পৃথিবী পালায় তিনি অঞ্জন আমি আইভি, জানোয়ার পালায় তিনি অরণ্য সেন আমি ঈশিতা, লোহার জাল পালায় তিনি প্রদীপ আমি তাটিনী। কত যে সুখের দিন ছিল তখন! একবার একটা মজার ঘটনা ঘটে। লোহার জাল পালায় আমি তটিনী চরিত্রে অভিনয় করছি। নায়ক প্রদীপের আমি সত্মা। অমলেন্দু হলো প্রদীপ। মানে আমরা মা ও ছেলে। আমি মঞ্চে উঠে বলছি, 'তুমি কেমন ছেলে রে বাবা! সত্মা হলেই যে রাক্ষুসী হয়, এমন কথা কে বলেছে শুনি?' এমন সময় প্রদীপ মঞ্চে এসে বলে, 'তুমি আমার মা?' এই সময় এক ভদ্রলোক দর্শক সারি থেকে মঞ্চের ওপর উঠে একেবারে রেগেমেগে বলছেন, 'আরে মশাই, আপনারা কী শুরু করলেন? নিজের বউকে মা বলে ডাকছেন! আপনার লজ্জা-শরম কিছু নাই নাকি?' বিশ্বাসবাবু বোঝানোর চেষ্টা করছেন, 'এটা সত্যি নয়, অভিনয়। মঞ্চে এ রকম বলা যায়।' কিন্তু কে শোনে কার কথা? অনেক কষ্টে ওই ভদ্রলোককে নিবৃত্ত করে তবেই আমাদের পরের দৃশ্যে যেতে হলো। আরেক দিন মমতাময়ী মা পালায় আমার অভিনয় দেখে আসরজুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়। আমি গ্রিনরুমে এসে পোশাক বদল করে বসে আছি। একজন লোক এসে আমার চরিত্রের নাম ধরে খুঁজছেন। তিনি নাকি আমাকে পুরস্কার দেবেন। আমি এগিয়ে বলাম, 'এই যে আমি।' তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। পরের দৃশ্যে যখন মঞ্চে গেছি, তখন বুঝতে পারলেন যে এই আমি আর সেই আমি একই। তখন মঞ্চে এসে আমাকে ১০০ টাকার একটি নোট উপহার দেন তিনি। সেটি আমার কাছে অনেক বড় উপহার। ১৯৭৭ সালে উত্তরবঙ্গের পাটগ্রাম কলেজ মাঠে এক সপ্তাহ ধরে অভিনয় করছি। একেক দিন একেক চরিত্রে। কলেজ কমিটি ও গ্রামবাসী মিলে আমাকে সংবর্ধনা দিয়ে 'যাত্রাসম্রাজ্ঞী' উপাধি দেয়। এ রকম আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছি। একবার ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুরে অভিনয় করছি। তখন আমাদের দলের জয়জয়কার সারা দেশে। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে প্যান্ডেল। একদিন অভিনয়ের পর এলাকায় এত সুনাম ছড়ায় যে পরের দিন মানুষ ছুটে আসে। টিকিট শেষ হয়ে গেলেও মানুষের সারি শেষ হয় না। প্যান্ডেল প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। সে কী অবস্থা! মানুষের এত আগ্রহ খুব কমই দেখেছি। শেষে প্যান্ডেল এক রকম খুলে দিতে হয়। ভালোবাসার বিপরীতে মানুষের কাছ থেকে লাঞ্ছনাও কম পাইনি। সে কথা বলছি না আর। একটা অন্য রকম ঘটনা বলি। আমাদের দেশে যেসব পালা মঞ্চস্থ হয়, তার প্রায় সবই পশ্চিমবঙ্গের পালাকারদের লেখা। এ দেশে মৌলিক পালা লেখার লোক তেমন নেই। বিশ্বাসবাবু ও আমি এ দেশের খ্যাতিমান নাট্যকারদের অনুরোধ করলাম পালা লিখে দেওয়ার জন্য। অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু পাণ্ডুলিপি পেলাম দুজনের কাছ থেকে। নরেনদা, মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসের যাত্রারূপ করে দিলেন। আর মামুনুর রশীদ তাঁর নাটক এখানে নোঙর নাটকের যাত্রারূপ করে দিলেন। আমরা প্রথম বছর মামুনুর রশীদের এখানে নোঙর যাত্রাপালা মঞ্চায়নের আয়োজন করলাম। মামুন ভাই তখন বিশ্বাসবাবুর সঙ্গে দীর্ঘদিন আলাপ করে, যাত্রা দেখে তাঁর নাটকের রূপান্তর ঘটালেন। আমাদের সঙ্গে মানিকগঞ্জে জোবরা গ্রামেও গেছেন একাধিকবার। এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে ওই পালা রচনা করলেন। আমরাও আনন্দিত, দেশের একজন খ্যাতিমান নাট্যকারের লেখা পালা আমাদের দলে প্রথম মঞ্চায়ন করেছি। আমাদের দলে লেনিন, হিটলার, মাইকেল, জানোয়ারসহ প্রভৃতি পালা মঞ্চায়ন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। এবার মামুনুর রশীদের এখানে নোঙর করে নতুন ইতিহাস করব। অনেক উত্তেজনা আর প্রত্যাশা নিয়ে মঞ্চে উঠেছি। দুটো দৃশ্য হয়ে গেছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেমন যেন মনে হচ্ছে। হঠাৎ কয়েকজন দর্শক উঠে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন নিজেকে এলাকার চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে মঞ্চে উঠে এসে বললেন, 'ভাই, আপনারা এই নাটক বন্ধ করুন। আমরা যাত্রা শুনতে আসছি। যাত্রা শোনান।' যতই তাঁদের বোঝানো হচ্ছে, এটি দেশের একজন বড় নাট্যকারের লেখা যাত্রাপালা, তাঁরা কিছুতেই শুনতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য, 'টিকিট কেটেছি যাত্রা দেখার জন্য, নাটক দেখতে চাই না।' কী আর করা, এখানে নোঙর পালার মঞ্চায়ন ওখানেই শেষ। ওই রাতেই শুরু হলো আরেক পালা অচল পয়সা। দর্শকেরা শান্ত হয়ে যাত্রা দেখল। নাটক থেকে যাত্রা যে আলাদা, তা সেদিন সাধারণ দর্শক বুঝিয়ে দিল। বহুদিন তো হলো, যাত্রার সঙ্গে আমার ঘর-সংসার। আমার স্বামী এ দেশের শ্রেষ্ঠ যাত্রাব্যক্তিত্ব। দেশের মানুষ তাঁকে নটসম্রাট আখ্যা দিয়েছেন। রাষ্ট্র তাঁকে 'একুশে পদক' দিয়ে সম্মান জানিয়েছে। আমাকে লোকে 'যাত্রাসম্রাজ্ঞী' বলে ডাকে। আমার মেয়ে অরুণা বিশ্বাসকে সবাই চেনে। আমার ছেলে মিঠু বিশ্বাস নাটক পরিচালনা করছে। আমি লিখেছি যাত্রাওয়ালা নামের একটি ধারাবাহিক নাটক। মঞ্চের জন্যও লিখেছি যাত্রাপালা রক্তস্নাত একাত্তর। গঠন করেছি অমলেন্দু বিশ্বাস কল্যাণ ট্রাস্ট। যাত্রায় যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রেখেছেন তাঁদের আমরা সম্মান জানাতে চাই। চাই অমলেন্দু বিশ্বাসের জীবনী রচিত হোক। যাত্রার জন্য একটা জাদুঘর করতে চাই। যাত্রার দুস্থ শিল্পীদের সহায়তার জন্য ফান্ড গঠন করতে চাই। যাত্রার ঐতিহ্য নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। যাত্রাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার একটা উদ্যোগ নিয়েছে। একটা কমিটির মাধ্যমে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই কমিটিতে আমরা যারা আছি, আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। সেটির বাস্তবায়ন হলে যাত্রার দুর্দশা কিছুটা ঘুচতে পারে। আমরা যাত্রার জন্য প্রতি রাতের অনুমতি নেওয়ার প্রথা বাতিলের কথা বলেছি। অশ্লীল নৃত্যের জন্য যাত্রাশিল্পীদের দায়ী করা হয়। কিন্তু এটি যে আয়োজকদের চাপে করতে হয়, সে খোঁজ কেউ নেয় না। এ কারণে গোটা যাত্রাসমাজের প্রতি দোষারোপ করা হচ্ছে। এ বছর প্রায় ৪০টি দল মাঠে ছিল। আমিও চারণিক অপেরা নিয়ে সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলাম। আমি আগেই জানিয়েছি যে আমার দলে কোনো নাচের মেয়ে নেই। আয়োজকেরা তাতেই রাজি হয়েছে। বলেছে, 'দিদি, আমরা আপনার অভিনয় দেখতে চাই।' প্রথম রাত ভালোই গেল। দ্বিতীয় রাতে আয়োজকদের সুর পাল্টে গেল। বলে, 'দিদি, দর্শকেরা চাইছে। দু-তিনটা নাচের মেয়ে যদি আনা যেত, তাহলে ভালো হতো।' আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হইনি। দল নিয়ে ফিরে এসেছি। কিন্তু যাত্রা যাঁদের জীবিকা, তাঁরা তো প্যান্ডেল ফেলে চলে আসতে পারে না। আপস করেই তাঁদের গান গাইতে হয়। সেই ১৯৫৭ সাল থেকে প্রায় ৪৫ বছর ধরে যাত্রায় আছি সক্রিয়ভাবে। বছরে ছয় মাস যাত্রার ঋতু। প্রতি মাসে ২০ রাত হিসেবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রাত যাত্রামঞ্চে কাটিয়েছি। অথচ এই শিল্পের এখন দুর্দশা। এই দুর্দশা এখনো কাটাতে পারছি না। যত দিন বাঁচি, যাত্রা নিয়েই বাঁচতে চাই। আমি আজ যে জ্যোৎস্না বিশ্বাস, যাত্রামঞ্চই তাঁকে তৈরি করেছে। আমি যাত্রার জন্য আরও কিছু করে যেতে চাই। অনুলিখন: তপন বাগচী কীর্তনঝর্না সরকার বাবার কোলে বসেই কীর্তনের আসর অসম্ভব ভালো লেগে যায়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে রামযাত্রায় অভিনয়ের মাধ্যমে হাতেখড়ি হয়। পরে কিশোর বয়সে হাতেখড়ি হয় হরিণাম সংকীর্তনের। বাবার গড়া 'মঞ্জুশ্রী সমপ্রদায়' নামের কীর্তনের দলটি এখন পরিচালনা করছি আমার বোন মঞ্জুশ্রী সরকারকে নিয়ে। বাবা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামের বিজয়কৃষ্ণ ভাবুক। তিনি ছিলেন কবিয়াল বিজয় সরকারে শিষ্য। তিনি তাঁর বড় মেয়ে মঞ্জুশ্রীর নামে গড়ে তোলেন কীর্তনের দল। বাবার দলেই দুই বোন গান করেছি। দুই বোনের বিয়ে হয় দুই জেলায়। বড় বোনের বিয়ে হয় বরিশালের বানারীপাড়ার আটঘর-কুড়িয়ানা গ্রামের। তাঁর স্বামী হরেন্দ্রনাথ সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। আমার বিয়ে হয় মাদারীপুর জেলার সদর থানার কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। আমার স্বামী প্রফুল্ল কুমার সরকার এই দলের এখন মূল পরিচালক। ভগবানকে আরাধনা করা, প্রার্থনা করার একমাত্র মুখ্য পথই এই হরিণাম সংকীর্তন। আমরা একে ধর্মানুভূতিতেই মানি। তাই এর সঙ্গে মন-প্রাণ বেঁধে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পয়লা কার্তিক থেকে ৩০ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত বছরের এই আট মাস কীর্তনের দলের বিভিন্ন স্থানে থাকে। বর্ষা মৌসুমে ঝড়-বৃষ্টির জন্য কীর্তনের আসর তেমন একটা সম্ভব হয় না। তাই এই সময়টা বিশ্রামের। যদি কোনো পাকা মন্দিরের বড় ছাউনির নিচে আয়োজন করা হয় তবে অল্প-বিস্তর আসরের আয়োজন করা হয়ে থাকে। অনেক পুরস্কার পেয়েছি। অনেকে কীর্তন আয়োজকদের কাছ থেকে স্বর্ণের মেডেলও পেয়েছি। আর পেয়েছি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। ১০টি ক্যাসেট বের হয়েছে কীর্তন ও কীর্তনভিত্তিক গানের। একদিন ভোর ছয়টা থেকে পরের দিন ভোর ছয়টা পর্যন্ত বিরতিহীন চলে এই তারকব্রহ্ম হরিণাম সংকীর্তন। একদিনে চার প্রহর। কোনো অনুষ্ঠান হয় অষ্টপ্রহরব্যাপী, কোনো অনুষ্ঠান ২৪ প্রহরব্যাপীও। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই কীর্তনকে প্রার্থনা হিসেবেই নেয়। আজ দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিকভাবেও এর প্রসার বাড়ছে। মানুষের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরেই বাংলাদেশে গান গেয়ে বেড়াচ্ছি। একটি কীর্তনের দলে ১২ থেকে ১৩ জন লোক থাকে। দলে যারা থাকে, তাদের সবার রুটিরুজির একমাত্র উপায় এই কীর্তন। দলের সবাইকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার পরে যা থাকে, তা-ই দুই বোনের একমাত্র অবলম্বন। খোল, বেহালা, দুটি জুড়ি, দোতারা বাজিয়ে কীর্তন করে। আর্থিক অবস্থা নির্ভর করে আয়োজকদের সাধ্যের ওপর। একেকটি আয়োজনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পায় একটি কীর্তন দল। দলের সবাই এই অর্থ পারিশ্রমিক অনুযায়ী ভাগ করে নেয়। কীর্তনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা যত দিন আসরে অংশ নিতে পারেন তত দিনই তাঁদের আয়। যখন বয়স বাড়ে। পরিশ্রম করা সম্ভব হয় না তখন তাঁদের দুর্দশা কেউ দেখে না। তাই এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কোনো বিকল্প নেই। দেশে সাড়ে চার শর বেশি কীর্তনিয়া দল আছে। এর মধ্যে কিছু দল আছে দেশব্যাপী আলোচিত। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই কৃষ্টি হারিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সরকারিভাবেই এগিয়ে আসা উচিত। বর্তমানে মঞ্জুশ্রী সম্প্রদায় পরিচালনা করছেন আমার স্বামী প্রফুল্ল কুমার সরকার। দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই বাস করি। ছেলে প্রদীপ কুমার সরকার মাদারীপুরের কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুর উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সারা দেশে আমাদের দুই বোনের নামডাক শুনে আমাদের ছেলেমেয়েরাও গর্ববোধ করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বায়না করার জন্য মানুষ ছুটে আসে আমাদের বাড়িতে। পাড়া-প্রতিবেশীরাও এতে গর্ব করে। বছরের আট মাস বাড়ির বাইরে থাকলেও ছেলেমেয়েদের কোনো আক্ষেপ নেই। এক নাগাড়ে চার-পাঁচ মাসও থাকতে হয় বাড়ির বাইরে। এর জন্য ছেলেমেয়েদের মনে কোনো দুঃখ নেই। এখন টেলিফোনের যুগ, প্রতিদিন খবর নেওয়া যায়। একসময় তা ছিল না। ছোট ছেলেমেয়েদের রেখেও গান গেয়ে বেড়িয়েছি। কেবল রোজগারের আশায় তা কিন্তু নয়। এর সঙ্গে মানুষের প্রতি ভালোবাসা আছে। সৃষ্টিকর্তার গুণকীর্তনে পুণ্য আছে। যখন ভাবি আমাদের গান শোনার জন্য হাজার হাজার মানুষ আসবে, তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারি না। ভক্তদের টানে ছুটে যাই। গানের আসরই মনে হয় আমার সংসার। এ কথা ঠিক যে আমরা যে গান করি, তাতে হিন্দুধর্মের সাধন-ভজনের কথা থাকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই কীর্তনিয়া পেশাকে খুব সম্মানের চোখে দেখে থাকে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের যেসব হিন্দু সম্প্রদায় বাস করে, তারা আমাদের দলের নাম এবং দুই বোনের নাম জানে। এটা আমাদের গর্ব। আমরা আমাদের মা-বাবার জন্য খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি নিজেদের। তাঁরাই আমাদের দুই বোনকে সংগীতের পথে উৎসর্গ করেছেন। আমরা সারা বছরই বিভিন্ন এলাকায় যাই। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ দেখি অনুষ্ঠানে। মহেষখালী দ্বীপে সাগরের মধ্যে যে মন্দির, যেখানে অনুষ্ঠান করেছি। কী যে অনুভূতি হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন মন্দিরে অনুষ্ঠান করেছি। সারা বাংলার একেক জায়গায় একেক রকম অবস্থা। রাজশাহী, নাটোরের জয় কালীবাড়ি, রাজারবাড়িতে অনুষ্ঠান করেছি। সেখানকার আয়োজন এক রকম। এ বছর মাদারীপুর, বাগেরহাট ও নড়াইলে গান করেছি। আমাদের ধর্মানুষ্ঠানে আমরা শ্যামাপূজা করি। নলুয়া চট্টগ্রামে। যেখানে মা মাটির নিচ থেকে নিজে উঠেছে বলে স্থানীয় মানুষেরা বিশ্বাস করে। কষ্টিপাথরের মূর্তি মায়ের সামনে ধূমধাম করে পূজা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ আসছে। মেদিনী বাবুর বাড়ি, বিরাট অনুষ্ঠান হয়। লাখ লাখ মানুষ আসে দেশের বিভন্ন এলাকা থেকে। বৈষ্ণবসভা, ব্রাহ্মণ, কাপড়চোপড় দান, কত কিছু, কত আয়োজন! আমরা খুব আনন্দের মাঝারে আছি। এই কীর্তন করতে করতে যদি জীবনের শেষও হয়ে যায় তাতেও আমাদের কোনো দুঃখ নেই। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে কষ্ট হয়। কিন্তু যখন হরিণাম নিয়ে আমরা লাখ লাখ মানুষের মধ্যে যাই, তখন সেই কষ্ট আমরা ভুলে যাই। আমার বড় দিদি মঞ্জুশ্রীর নামে আমাদের দল। কোনো আসরে যখন লাখ লাখ মানুষ বলে আমরা মঞ্জুশ্রীর দুই বোনের গান শুনতে চাই। তাঁদের নামযপের সময় কখন, তখন কী যে আনন্দ লাগে! এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সব কষ্ট তখন ভুলে যাই। আমার বাবা আমাদের অনেক কষ্ট করে গান শিখিয়েছেন, কীর্তন শিখিয়েছেন। পাকিস্তান আমলে মেয়েরা খুব বেশি স্বাধীনতা নিয়ে চলাফেরা করতে পারেনি। এমন বৈরী পরিবেশে বাবার উৎসাহেই আমাদের এই পথে আসা। দুই বোনের বিয়ের আগে এলাকায় ও আশপাশের জেলায় অনুষ্ঠান করেছি। আমাদের দুই বোনের বিয়ের পর পাঁচ-ছয় বছর অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। সন্তানাদি হওয়ার পরে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের উৎসাহে স্বাধীনতার পরে পূর্ণ উৎসাহ নিয়ে আমরা আরও সংগঠিতভাবে দল গঠন করি। সেই থেকে অনবরত পথচলা শুরু হয়েছে। এখন ঠাকুরের নামেই সারা দেশে ঘুরছি। আমাদের এই নামের মধ্যে কোনো কষ্ট নেই। '৭৪-এ স্থায়ীভাবে দল গঠন করে পথে নেমেছি। আমরা এখনো হরিনামের কীর্তনের পথেই আছি। আমার দিদি মঞ্জুশ্রী কোটালীপাড়া বাবার বাড়িতেই স্থায়ী বাসস্থান গড়েছেন। তাঁর দুই ছেলে বাবুল সরকার ও অনিরুদ্ধ সরকার। মেয়ের নাম বিনীতা বিশ্বাস। ৬ এপ্রিল কীর্তনের দলটি ছিল বাগেরহাট জেলায়। পরের দিন ৭ এপ্রিল বাগেরহাট ছেড়ে আমরা চলে আসি নড়াইলে। এখানে তাদের জন্য বড় আয়োজন। আগামী চৈত্রসংক্রান্তির দিনে আমরা কীর্তনের দল নিয়ে দেশের বাড়িতে ফিরব। বাঙালি জীবনের উৎসবমুখর পয়লা বৈশাখে আমরা মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে থাকব পরিবার-পরিজনের সঙ্গে। অনুলিখন: জহিরুল ইসলাম খান জারিগানআবদুর রহমান বয়াতি দেখতে দেখতে বয়স আমার ৭০ পার হলো। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারির এক তারিখে আমার জন্ম। চার যুগ ধরে বাংলার মঞ্চ মাতাইছি। এখন কথা কইতে পারি না। সব কথাই শুনতে পাই, বুঝতে পাই, কইতে চাই কিন্তু পারি না। সবচেয়ে বড় কষ্ট, এখন গান গাইতে পারি না। আমার একটা গান আছে—দেহঘড়ি। গানটা আমাকে কিছু দিছে। এর জন্য অনেক প্রশংসাই পাইছি। এর বাইরে আরও অনেক গান গাইলাম। এ দেশের সবখানেই গান করছি। আমার গুরু আলাউদ্দিন বয়াতির গানসহ আফতাবের গান, লালনগীতি, কবিগান, জারিগান, বিচারগান, সারি, মারফতি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, এর বাইরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, বৃক্ষরোপণ, নির্বাচনী, টিকাদান, দুর্যোগ-বন্যা—এসব বিষয়ে গান বানাইছি আর গাইছি। সব মিলাইয়া শ তিন-চাইর শ হইব আমার লেখা গান। 'মরণের কথা কেন স্মরণ করো না', 'আমার এত সাধের রংমহল ঘর ইঁদুরে কেটে বিনাশ করতেছে', 'আমার মাটির ঘরে ইঁদুর ঢুকেছে', 'আমি ভুলি ভুলি মনে করি প্রাণের ধৈর্য মানে না', 'হাটের মাঝে ভাঙল হাঁড়ি, টাকুরটুকুর বাজে ঢোল', 'আয় রে পাগলের দলে আয়', 'ঘুড্ডি হয় তিন তালা', 'কাম কামেলা খেলছে খেলা বাতাস পাইয়া', 'বাবায় আমায় দিল বিয়ারে, বুড়া জামাই চাইয়া', 'আমায় এত দুঃখ দিলি বন্ধুরে', 'মনপাগলে কাঁটাবনে মধু খাইতে যাইয়ো না', 'আমাদের বাংলাদেশের গান'—এ রকম আরও অনেক গান সারা দেশের মানুষ শুনছে। আমার গানের মূলভাব হইল 'মানুষ'। কইতে আইলাম, কই যামু, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব এক, জাত নাই, ধর্ম নাই, সবাই মানুষ একই। আব্বার বেশির ভাগ গানই দেহতত্ত্বের গান। আমার দেহঘড়ি গানটিও মূলত দেহতত্ত্বের গান। দেহের ভেতর যে কলকব্জা রয়েছে, তারই বর্ণনা। জারিগানে আবদুল গণি, খবির দেওয়ান, মোসলেম উদ্দিন, সাইদুর রহমান; পালাগানে খালেক দেওয়ান, রজব আলী দেওয়ান, দলিলুদ্দিন বয়াতি, হালিম বয়াতি, রশিদ সরকার, সমশের আলি, আলেক দেওয়ান, ননী ঠাকুর, মারফত আলী, আলাউদ্দিন বয়াতি, মাখন দেওয়ান, আবুল সরকার, পরেশ আলী দেওয়ান—এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে গান গাইছি। বিচ্ছেদী গানও গাইছ। ওটা পালাগানেরই একটা অংশ। পালাগান গাইতে গাইতে, রাত দুইটার পর বিচ্ছেদী গান গাওয়া বিজয় বিচ্ছেদী গান খুব নাম করেছে। কবিয়াল বিজয় সরকারের গানকে 'বিজয় বিচ্ছেদ' বলে। আর আমার গানগুলো একটু হালকা, মানে পাবলিক শুনতে খুব মজা পাইত। যেমন 'পিরিতে কইরাছে কলঙ্কিনী, প্রাণ সজনী, পিরিতে কইরাছে কলঙ্কিনী', 'আমি ভুলি ভুলি, মনে করি সইগো, প্রাণের ধৈর্য মানে না, বন্ধুরে ভুলিতে পারি না'—এ রকম ষাইট-সত্তরটা বিচ্ছেদী গান বানাইছি। নবী-রসুল, আউলিয়া, সাহাবিদের নিয়ে অনেক জারিগান গাইছি। জারিগানের প্রায় ২০০ ক্যাসেট বাজারে আছে। আমাকে তো একসময় জারিসম্রাটও কওয়া হইত। অন্য গানের ক্যাসেটও পাঁচ-ছয় শ হইব। অ্যান কোম্পানি, ডন, দোয়েল, এইচআরসি, সাউন্ডটেক, এটিএন মিউজিকসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে ক্যাসেট আছে। ২৫-৩০ বছর আগের অল্প টাকার চুক্তিতে রেকর্ড হতো। আমি তখন একেক দিন একটা কইরা ক্যাসেট করতাম। ক্যাসেটে কবি আলাউদ্দিন বয়াতি, জালালুদ্দিন, খালেক দেওয়ান সাহেবের গান, রজব আলী দেওয়ান, মালেক দেওয়ান এ রকম প্রবীণ যাঁরা ছিলেন তাঁদের গানও গাইছি। তবে আমার গুরু আলাউদ্দিন বয়াতির গানই বেশি গাইছি। তাঁর প্রায় এক হাজার গান আছে। চার খণ্ড বইতে এগুলো ছাপা হইছে। ভালো কবি ছিলেন তিনি। আমেরিকা, স্কটল্যান্ড, জাপান, রাশিয়া, ইরান, ভারত, জার্মান, ইংল্যান্ড, বাহরাইন, আবুধাবি, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, কাতার—সব মিলে ৩০/৩৫ দেশে গান লইয়া ঘুরছি। । সিনেমার জন্যই গান গাইছি। সিনেমায় অভিনয়ও করছি। মাসুদ পারভেজের গুনাহগার ছবিতে গাইছি 'আল্লা মানুষ বানাইয়া খেলছ যারে লইয়া/সেই মানুষ কেমনে গুনাহগার', আমজাদ হোসেনের কসাই ছবিতে জারি সুরে গান 'আরে প্রথমে বন্দনা করি আল্লা মালেক সাঁই/যাঁর উপাস্য ত্রিভুবনে অন্য কেহ নাই', হূদয় থেকে হূদয় ছবিতে বিজয় সরকারের 'এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে/সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে', খান আতার ছবি ফারাক্কায় 'মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি' গানটা গাইছি। হাফিজ উদ্দিনের অসতী ছবিতেও একটা গান আছে। এখন বয়স হয়েছে। অধিকাংশ লোকশিল্পীর শেষকাল দারিদ্র্যে কাটে। আমার ব্যাপারেও হয়তো তেমন কিছু ঘটেছে। আমাদের আদিনিবাস বিক্রমপুরে। আমাদের চারতলা বিল্ডিং ছিল। আমার বাবা তোতা মিয়া হোটেলের ব্যবসা করতেন। ১৯৯৯ সালে সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে এখন ভাড়াবাসায় থাকি। ভাবলেই চোখে জল আসে। আমি গান নিয়ে পইড়া ছিলাম। অন্য কোনো পথে যাই নাই। আমার ছেলেও এই পথেই আছে। ২০০৩ সালে অসুস্থ হইয়া পড়ি। ডাক্তার বলে ব্রেইনে রক্তের ছিটা জইমা আছে। এগুলো ধীরে ধীরে কাইটা যাইব, সাত বছর চইলা গেল, ভালো তো হয় না। বিদেশ যাইতে পারলে হয়তো ভালো হইতে পারতাম। অসুস্থ হওয়ার পরে আর গান গাইতে পারি না। শিষ্যরা মাঝেমধ্যে আসে। আমার ছেলে আলমও গান করে। ও আমার লগে হারমোনিয়াম বাজাইছে। এখন কি-বোর্ড বাজায়। যা পায়, তা-ই দিয়ে চলি। এভাবে আর কত দিন, জানি না! অনুলিখন: সাইম রানা পালাগানইসলাম উদ্দিন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের কিচ্ছাকার-পালাকারদের মধ্যে আমিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে'র প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। শুধু তা-ই নয়, শহুরে শিক্ষিত ছাত্রদের মধ্যে তুলে দিয়েছিলাম নিজের করা সবচেয়ে জনপ্রিয় কিচ্ছা-পালা 'কমলারানীর সাগরদিঘি'। আমার সেই কিচ্ছাপালাটি নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ' বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটি নবযাত্রার সূচনা করে এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামীণ নাট্যাঙ্গিকটির পরিবেশনা করে আসে ভারতের জাতীয় নাট্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিল্লির এনএসডিতে এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি নগরে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে আমার কিচ্ছাপালা পরিবেশনার জন্য নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রী ও দোহারদের সঙ্গে করে সুদূর বিলেতের রাজধানী লন্ডনে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি। দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত যে আখ্যানগুলোকে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে 'গীতিকা' বা 'ব্যালাড' বলে উল্লেখ করেছিলেন পরবর্তীকালের গবেষকদের অনেকেই আবার সেই একই আখ্যানগুলোকে বলেছেন 'পালাগান'। স্থানীয়ভাবে তাকে 'কিচ্ছাগান' এবং 'পালাকার'কে সাধারণত 'কিচ্ছাকার' বা 'কিচ্ছাদার' বলা হয়। সাম্প্রতিককালের দিলু বয়াতী, শাহ জাহান বয়াতী, মিলন বয়াতী ও আলফাজ বয়াতীও কিচ্ছাগান পরিবেশন করে নাম কুড়োচ্ছে। আমার জন্ম ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার নোয়াবাদ গ্রামে। গ্রামীণ পরিবেশে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে নিজ গ্রামের মক্তবে আরবি শিক্ষা শুরু করি। কায়দা-আমপারার পাঠ চুকিয়ে কোরআন পাঠে উত্তীর্ণ হই। এ সময় নিজেও জানতাম না যে একদিন আমি কিচ্ছাকার হয়ে উঠব। অবশ্য মক্তবের আরবি শিক্ষা গ্রহণের মধ্যে একবার আমাকে ঝুমুরগান গাইতে হয়। সে এক ঘটনা বটে! আমাদের গ্রামে ঝুমুরযাত্রা হচ্ছে, বইটার নাম হলো 'কাশেম-মালা'। এই সময় আমি মক্তবে পড়ছি। তখন ছেলে দিয়ে মেয়ে বানাতে হতো। এই সময় মিউজিক স্টাফদের মধ্যে হারমোনিয়াম মাস্টারকে এক মাস কিংবা দুই মাসের জন্য কনটাক্টে আনতে হয়েছিল। ওই লোক কিন্তু বন্দনা গাইবে যে চারটা ছেলে তাকে বানিয়েছে। মেয়ে চরিত্রে যে অভিনয় করবে ওকে সে বানিয়েছে। সবকিছু হয়ে গেছে কিন্তু নায়কের চরিত্রে যে অভিনয় করবে কাশেম, ওই কাশেম পাচ্ছে না। একটা ছেলেকে আনা হয় কিন্তু তার কণ্ঠ মিলছে না। যে স্কেলে গান গাইব সে স্কেলে গলায় টান দিতে পারে না। প্রায় সাত-আটজন ছেলেকে দেখা হলো। কোনো ছেলেকে নায়ক বানানো যাচ্ছে না। গানে কণ্ঠ আসে না। আমি যদিও মক্তবে পড়ি কিন্তু মক্তব থেকে বাইরে এলে মাঝে মাঝে গানে টান মারি। তখন আমাদের এক দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই, নাম আবু সিদ্দিক, সে গানের মধ্যে অভিনয় করেছে, সে একদিন আমাকে বলে, 'এই তুই গান করবি? যদি গান করিস তয় সন্ধ্যেবেলা রিহার্সেলে আসিস।' আমি বললাম, 'না, আমি মক্তবে পড়ি আমার বাড়ির লোকজন যদি শোনে আমারে মাইর দেবে।' সে তখন বলে, 'আজ ভালো রিহার্সেল হইব, বাঁশি আসবে, ঢোল আসবে, সবাই আসবে তুই আসিস।' আমি এই কথা শুনে সেখানে যাই। দেখি সিরিয়াস রিহার্সেল হচ্ছে, আমি কয়েকজন লোকের পেছনে চুপ করে বসে থাকি। দেখি কাশেমের চরিত্রে কোনো ছেলের মাস্টারের সঙ্গে মিলছে না। এর মধ্যে ওই লোকটা, যে আমাকে প্রতিদিন বলে, মাস্টারের কানে গিয়ে বলেছে, সে আসছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটা আমার পেছনে এসে আমাকে পাঁজাকোলা করে ধরেছে। ধরে নিয়ে হারমোনিয়াম মাস্টারের সামনে নিয়ে বসায়। তখন দেখি আমার সারা শরীর দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। আর হারমোনিয়াম মাস্টার তখন রূপবানের গান বলছে, গুনাইয়ের গান বলছে, সব গান বলছে, খালি বলে তুমি একটা টান দেও, একটা টান দেও, দেখি তোমার সুরটা কেমন। এত করে বলছে কিন্তু আমার গান আসছে না। আমি দেখছি আমার কাপড়-চোপড় ভিজে যাচ্ছে। অনেক বলার পরে আমি গানে টান দিলাম। আমি হারমোনিয়ামের স্কেলের মধ্যে নিয়ে টান দিয়েছি। তখন বলছে, 'তুমার হইছে। তুমি যাও।' আমার একটা বড় ভাই ছিল ফাইজুর রহমান, আমার সে ভাইটা মারা গেছে। সে যাত্রাপালায় অভিনয় করত। উনার উকিল শ্বশুর কিন্তু আবার 'কাশেম-মালা' বইয়ের ম্যানেজার। এই উকিল শ্বশুর এসে আমার বড় ভাইকে ধরেছে যে, 'যদি তুমার ভাইরে না দেও তো এই বই নামানো যাইতেছে না।' তখন ভাই বলে, 'সে তো মক্তবে পড়ে ওরে তো দেওয়া যাইতাছে না'। উনি বললেন, 'মক্তবে পড়ুক অসুবিধা নেই... আমরা যে বইতে হাত দিছি ওর জন্য শুধু পারতিছি না... ও এই বইটা শুধু করে চলে আসবে।' উনি উকিল শ্বশুর, আমার ভাই খুব অরাজি হতে পারছে না। তখন ভাই বলে, 'ওরে দিয়ে বই করাইতে পারবেন?' লোকটা বলে, 'পারব।' তারপর সেই বই করলাম। এরপর আস্তে আস্তে গ্রামের আরও অনেক নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। এভাবেই মক্তব থেকে কোরআন পর্যন্ত পাঠ চুকিয়ে আমি গ্রামীণ নাট্যপালার অভিনয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ি। প্রথম পর্যায়ে 'কাশেম-মালা' ও 'দস্যু বাহরাম' নামের দুটি ঝুমুরযাত্রা পালায় অভিনয় করি। তখন আমার বয়স ১২-১৩ বছরের মতো। এ সময় গ্রামের মানুষজন নিয়ে নাটক করি। নাটকের নাম জীবন্ত কবর। একদিন আমাদের এলাকায় কিচ্ছাগান করতে আসেন কুদ্দুস বয়াতী। তাঁর কিচ্ছার আসর দেখে আমি তাঁকে ওস্তাদ মেনে নিই এবং তাঁর বাড়ি যাই। আমি যাওয়ার পরে উনি বলছিলেন যে 'তুমারে আমি এক বৎসরের মধ্যে স্টেজে তুলব। এক বৎসরের মধ্যে তুমি কিচ্ছা করতে পারবা।' পরে তাঁর সঙ্গে থাকি, ঘুরিফিরি। এই সময় একটানা ছয় মাস আমি আমার বাড়িতে ছিলাম না। ছয় মাস আমার গুরু কুদ্দুস বয়াতীর সঙ্গে থাকার পরও আমি কিছু ধরতে পারছি না, কিচ্ছার কিছু বলতে পারছি না। কারণ, তিনি আমাকে নিয়ে বসেন না, রিহার্সেল করেন না, আলাদাভাবে বসেন না, কিচ্ছার কাহিনিগুলো বোঝান না। তখন কুদ্দুস বয়াতীর ডাইনা বিষ্ণুপদের কাছে বললাম, আমি তো এখনো কিছুই পারি না, কিন্তু আর ছয় মাস গেলে আমার সময় শেষ, এখন পর্যন্ত আমি স্টেজে বন্দনা গাইতে পারি না। উনি আমাকে বললেন, 'তুমি আমাদের দলের তবলচি মাস্টার হাশেমের কাছে যাও, সে আমার থেকে বেশি অভিজ্ঞ।' এই হাশেম আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করত। এখন পর্যন্ত এই হাশেম আমার খবর নেয়। পরে আমি হাশেমের কাছে গেলাম। সে আমাকে বসে বসে কিচ্ছার গল্পগুলো বোঝায়। কিন্তু আমার ওস্তাদ জানে না যে আমি হাশেমের কাছ থেকে গল্পগুলো শিখে নিচ্ছি। ওই সময়ে একদিন বাড়িতে এসে আমি একটা ডায়েরি নিয়ে যাই। পরে যে কোনো জায়গায় যে কিচ্ছার প্রোগ্রাম করে আমি ওই প্রোগ্রামটা আমি আমার ডায়েরিতে তুলে রাখি। তবে আমার ওস্তাদ জানে না যে আমি ডায়েরি করি। পরে আমি তিন মাসের মধ্যে আমার ওস্তাদের সবগুলো কাহিনি ডায়েরিতে লিখে শেষ করে ফেলি। এই করে নয় মাস হয়ে গেছে আমার। এরপর চৈত্র মাসের দিন আসে। আমার ওস্তাদ বলে, 'অনুষ্ঠান নাই, ল একটা কাজ করি।' 'কী কাজ?' 'ব্যবসা করি।' আমি বলি, 'কীসের ব্যবসা?' 'সাইকেল লইয়া আটার ব্যবসা।' তখন আমি বললাম যে 'ওস্তাদ আমি ব্যবসা করতাম না। আমি আমার কাজ করবাম চাই।' 'কী কাজ?' 'যে আমাকে আপনার যে বাদ্যযন্ত্রগুলো আছে ওগুলো আমারে দিয়ে দেন আমি ভাটি এলাকায় পালাগান করতে যাইতে চাই।' আমার কথা শুনে সে বলছে, 'তুমি কি পারবা এই কিচ্ছাগান করতে?' আমি বলি, 'চেষ্টা করি। চেষ্টা করে দেখি।' 'তে তুমি কোন পর্যন্ত গেছো তা আমি জানি না...তুমারে আমি শিখাইছি না।' 'আমি যেটুকু জানি সেটুকু নিয়েই চেষ্টা করে দেখি কিছু করতে পারি কি না।' পরে উনার যে গানের কারিগর ছিল হারমোনিয়াম মাস্টার নিজামউদ্দিন, তবলচি মাস্টার নিমাই এবং ডাইনা এই তিনজন লোক নিয়ে প্রথম গেলাম কদমশ্রী গ্রামে। কদমশ্রী গেলাম এই কারণে যে আমি নতুন, আমি কিচ্ছা এখনো গাই না, প্রথমে তাই আত্মীয়-পরিচিতের গ্রামে গেলাম। আসলে কদমশ্রী গ্রামে ছিল আমাদের হারমোনিয়াম মাস্টার নিজাম উদ্দিনের ভগ্নীপতির বাড়ি। সে গ্রামে যাওয়ার পর লোকজন এসে বলে, 'নিজাম উদ্দিন, তুমি কারে নিয়া আইছো?' বলে, 'কুদ্দুস বয়াতীর ছাত্র।' বলে, 'কুদ্দুস বয়াতীর কিচ্ছাই ভালো লাগে না, তুমি কুদ্দুস বয়াতীর ছাত্র নিয়া আইলা।' কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না কিচ্ছাগান শোনার জন্য। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি রাত্রিবেলা নিজামকে বললাম, 'চান্নি রাত, কেউ যখন কিচ্ছাগান শুনতে চাইছে না তখন নিজেরা মিলে কয়েকটা গান করো। রাতটা পার করি।' তখন কুপি বাতি ধরিয়েছে। নিজাম উদ্দিন গান শুরু করেছে। গান গাইলে বেশ কয়েকজন মানুষ আসছে। পরে একজন মুরব্বি লোক এসেছেন, তিনি বলছেন, 'নিজাম উদ্দিন, গান তো শুনছি, তুমরা যখন কিচ্ছা নিয়া আইছো, তুমাদের কিচ্ছা একটু শুনি।' পরে আমি যখন প্রথম কিচ্ছার বন্দনায় টান দিয়ে একটা লাফ দিলাম তখন ওই লোকটা বলে, 'দাঁড়াও।' লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বলছে, 'দাঁড়াও।' তখন আমি চিন্তা করলাম, কুদ্দুস বয়াতীর গানই শোনে না। আর আমি প্রথম টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলছে, 'দাঁড়াও', তাহলে মনে হয় আমার কিচ্ছাও শুনবে না। লোকটা বলে, 'এই তুমি বসো।' তখন আমি বসলাম। তখন ওই লোক কয়েকজনকে বলছে, 'এই তোরা কি কিচ্ছা শুনবি?' সবাই এক সঙ্গে বলে, 'হ, হ, শুনব।' লোকটা বলল, 'তাহলে আমার বাড়িতে যাইয়া হ্যাজাক নিয়া দোকান থেকে ত্যাল ভরে নিয়ে আয়। কিচ্ছার ভাব ভালো আছে কিচ্ছা হবে।' লোক পাঠিয়ে দিয়ে তেলটেল ভরে এনে হ্যাজাক বাতির আলোয় আসর শুরু হয়ে গেল। আমার এই প্রথম কিচ্ছাগানের পালাটা ছিল গুলে হরমুজ। কেন্দুয়া থানার কদমশ্রী গ্রামে প্রথম কিচ্ছাগান পরিবেশন করার পর আমি যাই খালিয়াজুড়ি থানায়। এই থানার গোছিগাই, অ্যাড়াবাজ, নিজগাঁও, আড্ডা প্রভৃতি গ্রামে একটানা ২৪ দিন কিচ্ছা পরিবেশন করি। ২৪ দিনে খরচ বাদে আমি প্রথম জীবনের কিচ্ছাগানের সম্মানী হিসেবে ২৮৩০ টাকা অর্জন করি। তাদের নিজেদের মধ্যে চুক্তি ছিল যে যা কামাই হবে তার অর্ধেক পাবে ইসলাম উদ্দিন আর বাকি অর্ধেক পাবে গানের দলের বাকি তিনজন। আমার প্রথম আয় আমি ওস্তাদের হাতে দিয়ে আসি। আমি চিন্তা করলাম, আমি তো নিজের যোগ্যতায় আজ কামাই করতে শিখেছি। তারপর নিজে দল করলাম নিজের গ্রামে এসে। নিজ গ্রামে এসে প্রথম যে কিচ্ছাগানটি করি তার নাম উতলা সুন্দরী ও কাকাধরের খেলা। এরপর নিয়মিতভাবে নিজের দল নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে আমির সাধু, সুন্দরমতি, উর্বলা সুন্দরী, রাম-বিরাম, গেন্দেকুল, জাহাঙ্গীর বাদশা, মতিলাল, ফিরোজ খাঁ, রূপকুমার ইত্যাদি নামের কিচ্ছাগান পরিবেশন করি। একটা কথা বলি, আমি আমার জীবনকাহিনী নিয়ে একটা পালাগান রচনা করেছি। ২০০৭ সালে সেটি ঢাকায় পরিবেশন করি 'কিচ্ছাদার' নামে। এসব পালাগান করতে তো একটা ভাব লাগে। গ্রামে সেই ভাবটা পাওয়া যায়। গ্রামের জনগণ সব ভাষা বুঝতে পারে। আবার শহরে গেলে, শহুরে ভাষা বলতে আমাদের খুব ভেজাল হয়। ঢাকা গেলে একটু সমস্যা লাগে আমার বোঝাতে গিয়ে। ঢাকার লোকেরা বোঝেন, তবে একটু পরিশ্রম নিয়ে করতে হয়। যেমন গ্রামের অনুষ্ঠান আমি ছয় ঘণ্টা করলেও এতটুকু পরিশ্রম হয় না। কিন্তু ঢাকা শহরে দুই ঘণ্টা করলেই পরিশ্রম হয়। একটা হিসাবের ভেতরে কথা বলতে হয়। তবে, ঢাকাতে পালাগান করার জন্য স্থায়ীভাবে থাকতে চাই না। কেননা, যে আমি গ্রামে পালাগান করে ঢাকার মানুষের কাছে মর্যাদা পেয়েছি সে আমি ঢাকাতে স্থায়ীভাবে চলে গেলে মর্যাদাহীন হয়ে যাব। মানুষ আমার কাছে আসে, সুন্দরভাবে পালাগানটা করি বলে। হয়তো ঢাকাতে সুন্দরভাবে পালাগানটা ধরে রাখতে পারব না। আমি গ্রামে থেকেই পালাগান করতে চাই। গ্রামের পালাকার হিসেবে আমার এই প্রত্যয় আমাদের চলতি হাওয়ার সঙ্গে বদলে যাওয়ার রীতির প্রতিবাদ হয়ে ধরা দেয়। আমরা ভাবতে থাকি কীর্তিমান হওয়ার পথে যেন নিজের স্থানটি না হারিয়ে ফেলি এবং ভুলে না যাই নিজের বলয় এবং বেড়ে ওঠার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। অনুলিখন: সাইমন জাকারিয়া কবিগানমদন সরকার 'মোক্তারিতে হয়ে ফেল, মোছে দিলেন কেরাসিন তেল।' জেঠামশাই মোক্তারি ছেড়ে দিয়ে দেশবিদেশে কবিগান করে বেড়াতেন। জেঠামশাইয়ের নাম বিজয়নারায়ণ আচার্য। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের অন্যতম কবিয়াল। নেত্রকোনা কোর্টে তিনি মোক্তারি করতেন। এই পেশায় অবশ্য তেমন যশ করতে পারেননি। কবিগান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। শশীমোহন আচার্য আমার বাবা। আমার জন্ম ১৩২৪ সালের আশ্বিন মাসে সহিলপুর গ্রামে। সহিলপুর গ্রামটি নেত্রকোনা জেলার সদর থানার সিংহের বাংলা ইউনিয়নে। আমার পুরো নাম মদনমোহন আচার্য। কেউ ডাকে মদন আচার্য, কেউ বলে মদন ঠাকুর, আর কেউ বা কয় মদন সরকার। মদন সরকারই বেশি ডাকে। আমার আর একটি নাম আছে। পাবার দেওয়া। ইন্দুভূষণ আচার্য। এ নামে আমাকে কেউ চেনে না, এ নামে কেউ ডাকেও না। নাম বদলের একটি কাহিনি আছে। আমার জন্মসালে নেত্রকোনায় কবিগান গাইতে এলেন বরিশালের মদন শীল। তিনিও পূর্ববঙ্গের খ্যাতিমান কবিয়াল ছিলেন। আসরে কবির লড়াই বেঁধে গেল আমার জেঠা বিজয় আচার্যের সঙ্গে। সে লড়াইয়ে মদন শীলকে হারিয়ে বিজয় আচার্য সোনার মেডেল পেলেন। আনন্দে তিনি আত্মহারা। বাড়ি ফিরে দেখলেন আমার জন্ম হয়েছে। আনন্দে তিনি মদন শীলের নামের সঙ্গে মিল রেখে আমার নাম রাখলেন মদনমোহন আচার্য। বাবার দেওয়া নাম ইন্দুভূষণ স্কুলের কাগজপত্রেই রয়ে গেল। জেঠামশাইয়ের দেওয়া নামেই সবাই ডাকে। সহজে ডাকার জন্য অনেকে আমার নামের মোহনটা ছেড়ে দিয়ে শুধু মদন আচার্য বলে। আমি ব্রাহ্মণ বলে অনেকে মদন ঠাকুর বলে ডাকে। কবিগান গাইতে যেয়ে আমি কায়স্থের পদবি সরকার পেলাম। হলাম মদন সরকার। সরকার কায়স্থের পদবি হলেও কবিগানের 'সরকার' আলাদা পদবি। যারা কবিগান গাইত তাদেরই দর্শক-শ্রোতারা সম্মান করে 'সরকার' বলে সম্বোধন করত। ব্রাহ্মণ হয়েও 'সরকার' পদবিতে আমার মন্দ লাগে না। ভালোই লাগে। 'সরকার' তো দর্শক-শ্রোতাদের সম্মানের ডাক। এখন বয়স আমার ৯২ বছর। শরীর আর চলে না। কথা বলতেও কষ্ট হয়। বাড়িতে বসে কেবল মনে মনে সুর ভাঁজি। পুরোনো দিনের কথা মনে করি। আনন্দময় দিনের কথা ভাবি। কবিগানের সেই স্বর্ণযুগের কথা ভাবি। তখন আমার যৌবন ছিল। এখন আমি জীবনের শেষের দিকে। এখন—'শুভ্র বরণ করলাম ধারণ,/দাড়ি গোঁফে চুলে,/কেবল পান সুপারি মুলামুড়ি,/দন্তের অন্তকালে।/এখন আর যাই না লঙ্কা,/কাকলী হয়েছে বঙ্কা,/সমন রাজা বাজায় ডঙ্কা,/এ বুড়াকে ধরবে বলে।/সুখ গেল সরিয়া,/অন্ধকারে চলাফেরা,/পরের হাতে ধরিয়া।/শ্বাস ঘনঘন, কাশ ঘনঘন,/তব পদে নিবেদন করি পুনঃ পুনঃ,/যে তা-তা-তা বলে যেতে পারি মরিয়া।' পড়ালেখা বেশি করিনি। আটপাড়া থানার অভয়পাশা স্কুলে পড়েছি। তখন বড় বোনের বাড়ি রামেশ্বরপুর গ্রামে থাকতাম। অভয়পাশা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পড়া শেষ করে নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখানে দুই-তিন ক্লাস পড়েছি। লেখাপড়ায় মন বসে না। শুধু জেঠামশাইয়ের কবিগান আমাকে টানে। সেই টান এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। আমি ভেতরে ভেতরে তাও টের পাই তখন। কবিয়াল হিসেবে জেঠামশাইয়ের নাম তখন দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমিও কবিগানের নেশার প্রবল ঘোরে জেঠামশাইয়ের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াই। কবিগান শুনি রামু, রামগতি, রামদয়ালের মতো বড় বড় কবিয়ালের। মাঝে মাঝে আসরে উঠতাম জেঠামশাইয়ের আশীর্বাদে। তাঁর সুবাদে সম্মানও ভালো পেতাম। দিনে দিনে কবিগানে পাকা হতে লাগলাম। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী পড়ে তত্ত্বকথার সন্ধান করতাম। আমার সমসাময়িক সঙ্গী পেলাম সাধু সরকার, কালী ধর, ক্ষেত্রমোহনসহ আরও অনেককে। তাঁদের অনেকের নাম আজ আর মনে করতে পারি না। আমি ওস্তাদ কবিয়াল রামসুন্দরের কাছে দীর্ঘদিন পাঠ নিয়েছি। ১৮ বছর বয়সে আমরা ঘুরতে শুরু করেছি সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, গৌরীপুর, মুক্তাগাছা। অনেক জমিদারবাড়িতে কবিগান করেছি। সে সময় কবিগান শুনতেন জমিদার-নায়েবসহ সমাজের বড় বড় মানুষ। হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে কবিগান শুনত। আমার দলের খুব নামডাক ছিল। আমরা কয়েকজন কবি সরকার কথা দিয়ে কথা কেটে আসর জমাতাম। 'হিন্দু আনি, মুসলমানি, করতাম আমরা টানাটানি।' কখনো হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করে আমরা চিন্তা করিনি। সম্প্রীতি বজায় রাখতাম। ধর্ম যা-ই হোক, সবাই মানুষ। এই বোধ সবার মধ্যে ছিল। আমরা ভাবতাম: 'পাখির দুটি পাখাই সমান,/তদ্রূপ হিন্দু-মুসলমান।/এক পাখা কাটলে পরে,/পাখি কি আর উড়তে পারে।/পাখাহীন পাখির থাকে না পরান।' শ্রোতারা বসে কবিগান শুনত। টপ্পা চলত যুক্তি দিয়ে, শব্দের ছন্দ দিয়ে। যুক্তি শুনে দর্শকশ্রোতা হাততালি দিত। নিজেকে তখন জমিদার মনে হতো। সে সময় কবিয়ালের সম্মান ছিল, কদর ছিল। এখন নেই। সময় বদলে গেছে। দেখতে দেখতে পাল্টে গেল অনেক কিছু। কিন্তু আমাদের নিজস্ব সম্পদ কবিগানের দুর্দশা কাটল না। 'ব্রিটিশ রাজ্যের অবসান,/জিন্না আনল পাকিস্তান,/রাখল দেশের গৌরবমান/মূর্তি-মন্ত হইয়া,/ও তার ভাবলীলা অবসান,/রাজ্য ছাড়ল আইয়ুব খান,/দিনে দিনে টিক্কা, ইয়াহিয়া।/বহু সংগ্রাম করে শেষ,/শেখ আনল বাংলাদেশ,/শান্তি সুখে ছিলাম বেশ।/দেশবাসী যত,/আতাতায়ী যত ঢুকে পড়ে,/যেনতেন প্রাণে মারে।/আরো সকল সহকারে/ দুঃখ দিয়া কত।' কবিগান তো আর সারা বছর চলত না। তাই সংসার টানতে অন্য কাজও করেছি। কবিগানের পাশাপাশি পিতল, কাঁসার বাসনপত্রে খোদাই করে নাম লিখতাম। হরফপ্রতি আট আনা পেতাম। সে পয়সা সংসারের কাজে আসত। এ কাজটি আমি শিল্প হিসেবে মনে করতাম। দেখতে দেখতে অনেক কাল গড়িয়ে গেছে। গঙ্গা-পদ্মায় অনেক জল গড়িয়েছে। দর্শক-শ্রোতাদের রুচির বদল হয়েছে। ভাবের বদল হয়েছে। টাকার দরকার আমারও ছিল। তখন তা বুঝিনি। এখন সন্ধ্যাকালে বুঝি। এখন বুঝলেই কি, আর না বুঝলেই কি? সময়ের কাজ সময়ে করিনি। তবে তার জন্য কোনো খেদ নেই। টাকার দিকে তাকাইনি। আমি গান চাইছি। তাই দিয়েই আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। 'হঠাৎ করে আইল ধন,/টাকার ভিতরে এত গুণ,/নির্দোষী হয় করিয়া খুন,/টাকার ভিতর দিয়া।/লোকে একটা কথা বলে,/পুত্রশোক টাকা ভুলে।/যত ইতি কর্ম চলে,/হাতের টাকা দিয়া।/টাকা জানি পরমার্থ,/টাকাহীনের জনম ব্যর্থ।/জনসমাজে অপদার্থ,/স্বার্থ কি আর বেচে।/ধার-কর্জ কেউ চাইলে দেয় না,/খাইছে কিনা খবর নেয় না।/গরিবের দায় এ যাতনা,/জীবন ভরা আছে।' শিল্পী হিসেবে দেশের মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কবি হিসেবে সম্মান পেয়েছি। সরকারের খাতায়ও আমার নাম আছে। সরকার আমায় বছরে ছয় হাজার টাকা ভাতা দেয়। হোক কম, তবু সরকারের সম্মানী! এটি আমার জন্য গৌরবের। নিজের আর কোনো আয় নেই। ছেলের আয়েই জীবন বাঁচাই। গ্রামের বাজারে ডাক্তারি করে আমার ছেলে রবীন্দ্র আচার্য। যা পায় তা দিয়ে তার ছেলেমেয়েসহ আমাকে নিয়ে কোনোক্রমে দিন চালায়। আমার স্ত্রী লাবণ্য বালা গত হয়েছে কয়েক বছর আগে। দুই মেয়ে শোভা ও বিভার বিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। সন-তারিখ মনে নেই। বিভা রামমঙ্গল গায়। কীর্তনের দল আছে তাঁর। এ দিয়ে সে সংসার চালায়। আমরা কেউ ভালো নেই। একবার আহার আরেকবার অনাহারে দিন চলে। শুধু অতীত মনে হয়। কী ছিলাম, এখন কী হলাম! 'এখন দল নাই,/ডুলি নাই।/বিপক্ষের সরকার নাই,/আমারে আর দরকার নাই।' এখন পারের আশায় বসে আছি। কখন তাঁর ডাক পাই—তখন তাঁর কাছে চলে যাব। আমার গাওয়া গান শুনে যে মানুষেরা খুশি হতো, তাদের কাছে থেকে যাবে আমার কবিতা, আমার গান, গানের সুর। এ ভেবেই মনে আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই। জীবনটাকে সার্থক ভাবি। অনুলিখন: আলী আহাম্মদ খান গম্ভীরামাহবুবুল আলম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমি প্রথম গম্ভীরা গান পরিবেশন করি। হঠাৎ করেই আমাকে সুধীজনের সামনে গম্ভীরা পরিবেশন করতে হয়। ১৯৬২ সালের কথা, দিন-তারিখ ঠিক মনে পড়ছে না। আমি তখন হরিপুর জুনিয়র মাদ্রাসার (বর্তমানে হরিপুর ১ নম্বর উচ্চবিদ্যালয়) চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। মাদ্রাসায় খবর এল স্কুল পরিদর্শনে ইন্সপেক্টর সাহেব আসবেন। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোফাক্কার হোসেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, ছোট আকারে হলেও একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। আর অনুষ্ঠানে অবশ্যই ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গান থাকবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল গম্ভীরা করবে কে, এই নিয়ে। প্রধান শিক্ষক সম্পর্কে আমার দাদা (আমার পিতামহের ছোট ভাই)। তিনি আমার সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের কথা জানতেন। তাই তিনি সহকর্মীদের বললেন, 'আমাদের মাহবুব তো একটু-আধটু গান করে আর মুখুটি (মুখরা) ভালো, পারলে ও-ই পারবে গম্ভীরা করতে।' যেই কথা সেই কাজ। গম্ভীরা লেখা হলো, শুরু হলো অনুশীলন। নির্দিষ্ট দিনে ইন্সপেক্টর সাহেবের সামনে গম্ভীরা পরিবেশন করা হলো। আমি ছিলাম নানার চরিত্রে। এই প্রথম মঞ্চে গম্ভীরা গেয়ে আমি যথেষ্ট প্রশংসা পেলাম। শিক্ষক, সুধীজন মন্তব্য করলেন, গম্ভীরা গান করলে মাহবুব একদিন নামকরা শিল্পী হবে। ইন্সপেক্টর সাহেব গম্ভীরার নানা চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে আমাকে পাঁচ টাকা বকশিশ দিলেন। সেদিন থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করলাম গম্ভীরা গান করা। সে সময় এখনকার মতো প্রতিষ্ঠিত তেমন কোনো গম্ভীরা দল ছিল না। তাই স্থানীয় স্কুল, ক্লাব বা যেকোনো উপলক্ষে অনুষ্ঠান হলেই আমাকে নানার চরিত্রে অভিনয় করতে হতো। বয়সে ছোট হলেও গম্ভীরা গান গাওয়ার কারণে সবাই আমাকে একটু বেশি স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন, যা আমাকে পুলকিত করত। পরে ঐতিহ্যবাহী হরিমোহন ইনস্টিটিউশনে (বর্তমানে হরিমোহন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) ভর্তি হওয়ার পর আমি স্কাউটিংয়ে যোগ দিই। স্কাউটিংয়ের সুবাদে জাম্বুরিসহ বিভিন্ন সমাবেশে গম্ভীরা গান পরিবেশনের সুযোগ পাই। এভাবে লেখাপড়ার পাশাপাশি সীমিতভাবে আমি গম্ভীরাচর্চা অব্যাহত রাখি। আম-কাঁসা-পিতল-লাক্ষা ও রেশনের জন্য বিখ্যাত অনন্য লোকসংগীত গম্ভীরা ও আলকাপ গানের তীর্থভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে আমার জন্ম। মহান ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালের ৮ জুলাই আমার জন্ম, এ জন্য আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। বাবার নাম সাদাতুল ইসলাম, মা বিলকিস বানু। আমি পেশায় ও নেশায় একজন গম্ভীরা শিল্পী। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হয়। নবগঠিত জেলার দ্বিতীয় জেলা প্রশাসক মো. নূরুজ্জামান মিয়া একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন—'গম্ভীরার জন্য বিখ্যাত এই জেলায় রকীবুদ্দীন-কুতুবুল আলমের দল ছাড়া আর কি কোনো গম্ভীরা দল নেই?' তখন জেলার বিশিষ্ট সাংবাদিক ডি এম তালেবুন নবী তাঁকে বলেন যে মাহবুব নামে একজন শিল্পী রয়েছেন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে গম্ভীরা অনুশীলন করে আসছেন। তাঁর কথার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে আমাকে দিয়ে গম্ভীরা পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেন। তালেবুন নবী বিষয়টি আমাকে অবহিত করলে আমি দল গঠনে প্রয়াসী হই। আলকাপ গানের এ সময়ের তুখোড় ছোকরা (আলকাপ গানে ছেলেরা মেয়ে সেজে অংশ নেয়) বরেন্দ্রনাথ ঘোষকে নাতি ও উৎসাহী কয়েকজনকে দোহারি ও যন্ত্রী হিসেবে নিয়ে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে দল গঠন করি। তখন থেকেই শুরু হয় সংগঠিত দল নিয়ে আমার গম্ভীরা গান। ১৯৮৬ সালে আমি দল নিয়ে বাংলাদেশ বেতারে কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় অংশ নিই এবং শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই। বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত দল হিসেবে অদ্যাবধি আমার দল গম্ভীরা পরিবেশন করে আসছে। ১৯৮৮ সালে আমি প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে গম্ভীরা পরিবেশনের সুযোগ পাই। টেলিভিশনে প্রথম অনুষ্ঠান আমার জন্য একটি দুর্লভ স্মৃতি হয়ে আছে। বাংলাদেশের একটি গম্ভীরা দল তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি লাভ করেছিল, দলটি হচ্ছে রকীবুদ্দীন-কুতুবুল আলমের গম্ভীরা দল। হঠাৎ একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, ১৯৯৫ সালে কুতুবুল আলম ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন রকীবুদ্দীন আমাকে অনুরোধ করেন নানা হিসেবে তাঁর দলে যোগদান করার জন্য। তাঁর কথায় সম্মত হয়ে আমি তাঁর দলে নানা হিসেবে যোগ দিই এবং জাতীয় প্রচারমাধ্যমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গম্ভীরা পরিবেশন করতে থাকি। ২০০২ সালে বাংলাদেশের গম্ভীরা গানের কিংবদন্তি শিল্পী রকীবুদ্দীন অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি আমাকে লোকসংগীতের এ সমৃদ্ধ ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ জানান। আমি তখন ফাইজুর রহমান মানিকে নাতি হিসেবে নিয়ে দল গঠন করি এবং দলের নাম রাখি, 'চাঁপাই গম্ভীরা'। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমার গম্ভীরা দলের গান রচনা করেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। বর্তমানে আমি গম্ভীরা গান রচনাসহ দলনেতার দায়িত্ব পালন করছি। আমার দল ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটিসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গম্ভীরা পরিবেশন করেছে। দেশের ছয়টি বিভাগের ৪০টিরও বেশি জেলায় গম্ভীরা পরিবেশনের সুযোগ আমার হয়েছে। সূচনালগ্ন থেকেই আমি গম্ভীরার নানা চরিত্রে রূপদান করি, সেহেতু আমি এখন সবার কাছে 'নানা' হিসেবে পরিচিত। আনন্দের বিষয় যে ছেলেও ডাকে আমাকে নানা, আবার তার বাবাও ডাকে নানা বলে। গম্ভীরা যে আমাকে জনমানুষের কত কাছাকাছি নিয়ে গেছে, দর্শক-শ্রোতাদের অভিব্যক্তি দেখেই আমি তা অনুভব করতে পারি। এর চেয়ে বেশি আর কিছু পাওয়ার নেই। গম্ভীরা গান করতে গিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ ছাড়াও সরকারের কর্মসূচি, দেশের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। ইতিমধ্যে আমি প্রাথমিক শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, গণযোগাযোগ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গম্ভীরা করেছি। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিওর গণসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী অনুষ্ঠান, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশনের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের নিরাপদ মাতৃত্ব, শিশুমৃত্যু হার রোধ, নির্বাচনী আচরণবিধি, ইউনিসেফের মানসম্মত শিক্ষা ও নারী শিক্ষার গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গম্ভীরা করেছি। ১৯৮৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমার দল প্রায় পাঁচ হাজার গম্ভীরা পরিবেশন করেছে। এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসা যাক। কথায় বলে, 'শিল্পীর গানে গগন ফাটে, শিল্পীর হাঁড়ি কুত্তায় চাটে।' গম্ভীরা পরিবেশন করে আর্থিকভাবে লাভবান না হলেও যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। আমি বর্তমানে একটি বেসরকারি কলেজে গ্রন্থাগারিক হিসেবে কর্মরত। ১৯৮৩ সালে আমি বিএ পাস করি। পরে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা করেছি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি বিবাহিত। গম্ভীরা গান করে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখন পর্যন্ত গম্ভীরা অনুশীলনের বা চর্চার জন্য নিজস্ব কোনো জায়গা বা ঠাঁই করতে পারিনি। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি—সবার কাছে ধরনা দিয়েছি, সবাই শুধু আশ্বাসই দিয়েছেন আর আমাদের ব্যবহার করেছেন। কোনো ফল হয়নি। প্রতিবাদী লোকসংগীত হিসেবে পরিচিত হলেও গম্ভীরা এখন আর আগের মতো নেই। একসময় গম্ভীরা গানে সমাজের অসংগতিগুলো আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসত। ফলে ভুল-ত্রুটিগুলো শোধরানো যেত। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা গম্ভীরা পরিবেশনের জন্য ডাকেন, গানে তাঁরা তাঁদের সাফল্যের কথাই বেশি করে তুলে ধরতে বলেন। তাঁদের অসংগতির কথা তুলে ধরলে পরে তাঁরা আর ডাকতে চান না। বর্তমানে কিছু এনজিও নিজেরা নিজেদের মতো করে গম্ভীরা দল গঠন করেছে। তারা শুধু নিজেদেরই গুণগান করে। এসব কারণে গম্ভীরার প্রকৃত উদ্দেশ্য খর্ব হচ্ছে। গম্ভীরা মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের গান। সাধারণত এ অঞ্চলের ভাষায় এ গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখ লাগে, বর্তমানে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও গম্ভীরা গান করছে। অন্য এলাকার মানুষ গম্ভীরা করলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষাকে বিকৃত করে তাদের গাওয়া গান গম্ভীরার যথার্থ মান ক্ষুণ্ন করছে। এতে গম্ভীরা স্বকীয়তা হারাচ্ছে। তাঁদের প্রতি আমার আহ্বান, গম্ভীরা গান যদি করতেই হয়, তাহলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষাকে আয়ত্ত করুন এবং শুদ্ধ ভাষায় গান পরিবেশন করুন। এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা অন্যান্য জেলার ভাষায় শ্রুতিমধুর হয় না, তেমনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা গানও অন্য জেলার ভাষায় শ্রুতিমধুর হয় না। জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোকে এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। গম্ভীরা গানের বিকাশে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক গান বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন একাডেমি বা পরিষদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমরা আজও কোনো গম্ভীরা একাডেমি বা সে ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি। গম্ভীরা গানকে বাঁচাতে, গম্ভীরা শিল্পীদের বাঁচাতে তথা গম্ভীরা চর্চার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই প্রয়োজন। এ জন্য আমরা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমার রচিত একটি গম্ভীরা গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করে আমার কথার ইতি টানছি। দুঃখের কথা কহি কাকে কে শুনবে হাঁর কথা গম্ভীরা গান গাহি হামরা মনে লিয়্যা ব্যথা-নানা হে। গম্ভীরায় সুদৃষ্টি দিলে শিল্পীদেরও সম্মান মিলে গম্ভীরা গান উঠবে জ্বলে কর চিন্তা-ভাবনা। অনুলিখন: মাযহারুল ইসলাম আলকাপকেরামত সরকার আলকাপই আমার প্রথম ভালো লাগা, যা আমি আজও বহু কষ্টের মধ্যেও লালন করে আসছি। এই আলকাপ গান আমি প্রথম শুনি আবদুস সাত্তার সরকারের কাছে। তিনি আমার দাদা। তা প্রায় ষাট বছর আগের কথা। তাঁর দলের গান শোনা ও দেখার পর থেকেই এই গানে হাস্যরসের যে মজা, তা আমাকে ভীষণভাবে টানে। আর সেই টানেই আমার আলকাপ গানে আসা। পূর্বপুরুষ থেকেই আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পলশা গ্রামের অধিবাসী। বাবা মো. মালেক উস্তুর একসময় নয়াগোলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। আমাদের অল্প কিছু জায়গাজমি আছে। ওই জমিতে চাষাবাদ আর কোর্টে মোহরার (আইনজীবীর সহকারী) কাজ করে সংসার চলে। সেই সঙ্গে আছে আমার আনন্দ-বিষাদের আলকাপ। খুব অবাক লাগবে যে, দাদার কাছে আলকাপ গান শুনলেও সেখান থেকে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা পাইনি। বরং উল্টোটাই হয়েছে। দাদা ও বাবা উভয়েই আমাকে আলকাপ গান করতে অনেকবার নিষেধ করেছেন। কিন্তু নিষেধ করলে কী হবে, তখন আমাকে আলকাপের নেশায় পেয়েছে। ঘনঘোর বর্ষার বিদ্যুৎ চমকানো রাতের পিচ্ছিল পথে যেমন পা টিপে টিপে রসের আধার শ্রীমতী রাধিকা পরমপুরুষ প্রেমময় শ্রীকৃষ্ণের জন্য অভিসারে বের হন—সবকিছু উপেক্ষা করে—ঠিক তেমনি আমি অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যেও লোকনাট্য আলকাপ ধরে রেখেছি। কষ্ট না করলে যেমন কেষ্ট পাওয়া যায় না, তেমনি অনেক দুর্যোগ আর অশান্তির মধ্যেও বুকে আছে এই গানের অদম্য পাগলপারা এক নেশা। এই অদম্য নেশার ঘোর কাটাতে বাবা আমাকে দুবার ঘরছাড়া করেন। 'ঘর বাইনু বাহির, বাহির বাইনু ঘর/পর বাইনু আপন, আপন বাইনু পর'। এ এক অদ্ভুত নেশার উন্মাদনা আর তার হাতছানি। ঘর ছাড়লেও ছাড়িনি প্রথম ভালো লাগাকে। অতঃপর আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা বাবাকে বুঝিয়ে শান্ত করলে আবার আমি ঘরে ফিরি। কেননা, ঘরই বোধহয় নিশ্চিন্ত আশ্রয়। আমি ঘরে ফিরলে বাবা অন্য রাস্তা খোঁজেন আমাকে ঘরমুখী করতে। তখন আমি সতেরো বছরের এক অস্থির যুবক। দুঃসহ এক বয়স। রক্তে আলকাপের নেশা। এ নেশার ঘোর কাটাতে বাবা আমার শক্ত কঠিন হাতের সঙ্গে এক নরম কোমল হাত মিলিয়ে দিলেন। বিয়ের পর স্ত্রীর প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়ে যদি আলকাপের নেশার ঘোর কাটে—এই ছিল আমার পিতৃদেবের ঐকান্তিক ইচ্ছা। কিন্তু মুচকি হেসেছিলেন বিধাতা। তাই আলকাপ থেকে সরে আসা হয়নি আমার আজও। সাতাত্তর থেকে অদ্যাবধি এই লোকনাট্য করে আসছি। আটাত্তরে এসএসসি এবং একাশিতে এইচএসসি পাস করি। তেরাশি সালে ফরম পূরণ করেও বিএ পরীক্ষায় বসা হয়নি। সে সময় আমার চাকরি হয়ে যায় বিআরডিবিতে; ১০ বছর আমি সেখানে চাকরি করি। আলকাপ গান করার জন্য কর্তৃপক্ষ আমাকে ছুটি দিতে আপত্তি করায় সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিয়ে চলে আসি। আমার আলকাপ গানের প্রকৃত গুরু বাদল পাল। তাঁর কাছেই আলকাপ গানের তাল, মান, লয়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর শিক্ষা পেয়েছি। ১০ বছর আমি এই গুরুর কাছে শিখেছি। দাদা আলকাপ গান করলেও আমার গান করা পছন্দ করতেন না বলে তাঁর কাছে আমার শেখা হয়নি। শ্রদ্ধেয় বাদল দা খুব মন দিয়ে শেখাতেন। তিনি আজ আর নেই। অপাপবিদ্ধ লোকে তাঁর বাস হোক এই প্রার্থনা করি। এই লোকনাট্য করা নিয়ে সংসারে অশান্তি আছে। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে—তারা কেউ চায় না আমি আলকাপ করি। কিন্তু আমি সবকিছু উপেক্ষা করেই এই গান গেয়ে চলেছি। এই গান করে আর্থিক সচ্ছলতা পাইনি। জীবন-জীবিকার জন্য তাই কোর্টে মোহরার কাজ করি, আর বাকি সময়ে জমি চাষাবাদ করি। তাতে করে বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে যায় সংসারের খরচ। এই গান করি মনের আনন্দে। দলে ১৫ জন লোক। এক আসর গান করে যে টাকা পাই, তাতে কোনোমতে যাতায়াত খরচ চলে। চাল-ডাল আর কেনা হয় না। জামা-কাপড় তো দূরের কথা। এক যুগ আগেও পূজা-পার্বণ উপলক্ষে আলকাপ করার জন্য ডাক পেতাম। রাতে পূজা, আরতি—এসব শেষ হয়ে গেলে প্রথমে যাত্রাপালা এবং পরে বসত আলকাপের জমজমাট আসর। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। দর্শক-শ্রোতা প্রাণভরে সেই সব আসরে উপস্থিত হতো। উপচে পড়া ভিড় চারদিকে। মধ্যখানে খোলা আসর। ওপরে টানানো থাকত চাঁদোয়া বা শামিয়ানা। জ্বলে উঠত হ্যাজাক কিংবা ডে-লাইট। এসব কিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুুত মজা আর আনন্দের সঙ্গে গানের আসরে গান করা। দুই দলে বসত আলকাপের আসর। কবিগানের লড়াইয়ের মতো জমে উঠত প্রাণবন্ত আসর। তখন তো চিত্তবিনোদনের জন্য ছিল না এত দূরদর্শন আর স্যাটেলাইটের সর্বগ্রাসী আগ্রাসন। এসবের দৌরাত্ম্যে তো গ্রামীণ ঐতিহ্য আর লোকসংস্কৃতি এখন মৃতপ্রায়। ধুকধুক করে কোনোমতে টিকে আছে। কবিগান, জারিগান, সারিগান, ভাটিয়ালি, যাত্রা, আলকাপ, কেচ্ছাকাহিনি, গম্ভীরা—সবই ধুঁকছে। কেউ বেশি, কেউ কম। আগে বিভিন্ন পূজা—দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী, রায়রাজা, বাসন্তী পূজা উপলক্ষে আমরা আমন্ত্রণ পেতাম আলকাপ করার জন্য। আমরাও মুখিয়ে থাকতাম এসব আসরে যাওয়ার জন্য। দলের ১৫ জনকে খবর দিতে হতো। সবাই এসে আমার বাড়িতে হাজির হলে একসঙ্গে আমরা রওনা দিতাম নির্দিষ্ট পূজামণ্ডপে গান করার জন্য। এখন আর আগের মতো পূজা-পার্বণে ডাক পড়ে না। কেমন যেন সব ঝিমিয়ে যাচ্ছে। যুগযন্ত্রণায় কাতর সবাই। উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নঁওগা জেলার মধ্যেই এই আলকাপ ঘুরপাক খায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় আলকাপ হয় বলে জানি। পূজা-পার্বণ ছাড়াও বিভিন্ন মেলা উপলক্ষে আলকাপের আসর বসে। আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মহারাজপুর মেলা, কানসাট মেলা, সরজন মেলা, কালুপুর মেলা—এসব জায়গায় আলকাপ করেছি। এসব মেলার আয়োজন কিছুটা ভিন্ন। মেলা কর্তৃপক্ষ প্যান্ডেল করে টিকিট-প্রথার মাধ্যমে গানের আয়োজন করে থাকে, যেখানে আমাদের প্রতি আসরে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। পূজা-পার্বণ আর মেলার বাইরে কোনো কোনো সময় ডাক পড়ে আলকাপ করার জন্য। আমি একে বলি ফরমায়েশি আলকাপ। সমাজের হয়তো নামীদামি কেউ ডেকে আলকাপ করতে বলেন। সময় দেন মাত্র আধঘণ্টা। এর মধ্যেই আসর শেষ করতে হবে। এভাবে আলকাপের আসর জমে না। তাও আবার এক দলের আসর। দুই দল থাকলে তবেই জমে আসর। 'আল' অর্থ হচ্ছে খোঁচা বা টিপ্পনী আর 'কাপ' আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে মশকরা বা কৌতুক। কৌতুকের রসে সমাজের অন্যায়-অসংগতি আলকাপ লোকনাট্যের মাধ্যমে শ্রোতা-দর্শকের সামনে আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করি। এটি এক ধরনের লোকনাট্য। গ্রাম্য গাথা, সাধারণ সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে এর পালা বা কাহিনি রচিত হয়। একটি দলের গঠন হয় সরকার (গানের রচয়িতা), ক্যাইপ্যা (নায়ক), ছোকরা (পুরুষ-মেয়ে সাজিয়ে ছোকরা করা হয়), দোহারি, ডুগি-তবলাবাদক, হারমোনিয়ামবাদক ও জুড়িবাদক—এসব নিয়ে। কোনো কোনো দলে আবার বংশীবাদকও থাকেন। প্রথমে গানের আসর শুরু করা হয় দেব-দেবীর জয়সূচক বন্দনা করে, তারপর করা হয় আসরবন্দনা। আসরবন্দনার পর সরকার দেবতা ও শ্রোতার উদ্দেশে প্রণতি জানিয়ে বন্দনা করেন। এর পরে ছোকরার খেমটা নাচ। নাচের পরে আলকাপের মূল কাহিনি বা ঘটনা বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে শ্রোতা-দর্শকের সামনে লোকনাট্যের ঢঙে অভিনয় করে পরিবেশন করা হয়। পুরুষেরা ধুতি ও শার্ট পরে এবং সঙ্গে একটা গামছা নিয়ে অভিনয় করে। আর মেয়েরা (পুরুষকে মেয়ে সাজানো হয়) শাড়ি পরে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে থাকে। আসরবন্দনার নমুনা এ রকম: 'এসো মা হূদে বিন্দুবাসিনী/ওমা তুমি সাকার, আমার অহংকার/মধুর ঝংকার মৃদু সুহাসিনী/মম হূদি মন্দিরে আমি দেখা দাও/অরূপ ছাড়িয়ে স্বরূপে দাঁড়াও/যুগল রূপে দীপালি জ্বালাও মা/প্রাণভরে ঈশান-ঈশানী/নাই কোনো শক্তি, নাই কোনো মোর ভাষা/তবুও গুণ গাহিবার আশা/প্রাণের পিপাসা মা মিটাও সেই আশা/মুখে দাও মা ভাষা মধুর ভাষিণী।' এরপর আলকাপ গানের সরকার বন্দনার মাধ্যমে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন। নাচোলের সাঁওতাল বিদ্রোহের ঘটনা আজ আর কারও অজানা নেই। এই নিয়ে লেখকেরা অনেক বইও লিখেছেন। তেমনি একটা বন্দনা: 'ইলা মিত্র করে আইন জারি/লেকচার দিল কত গো বন্ধুগণ/তার ফলে সাঁওতাল সব গেল জেলে/কোথায় গেল হাবু বাবু নাই অন্বেষণ/ওই ভারতের ঘরে ঘরে বিবাদ বাধিল/লীগ-কংগ্রেস আর মহাসভার দল গঠন হলো।/তার পরে কমিউনিস্ট হলো/ভারতটাকে ঘিরে নিল/ইলা মিত্র নামে নারী/লেকচার দিচ্ছে ভারী ভারী/বলব কি আর বলব ভাই তার কথা/বলতে প্রাণে কষ্ট হয় হয় গো ব্যথা/বলব কি আর/সে তো বাবুর পরিবার/দেখ নাচোল থানার ভিতরে/কত রকম অন্যায় করে/দারগা পুলিশ জমাদার/মেরে করিল ছারখার/রাখিল জেলের ভিতরে/গভর্নর জানতে পেরে/পুলিশ পাঠায় ঘরে ঘরে/সাঁওতাল-ধরিবার তরে গো/কিছু কিছু ধরা পড়ল/বাকিরা সব লুকাইল/লুকায়ে ভাবে মনে মনে/পাকিস্তান আর রবে না।' আলকাপে হাস্য-কৌতুকের মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে সরস করে সহজ ভাষায় দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়। তবে এখন যুগের দাবির কারণে আলকাপে কিছু পরিবর্তন দরকার। বিশেষত, মেয়েদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে। এখন আমরা আলকাপ করতে গিয়ে ঠিক বুঝতে পারি যে দর্শক আর ছোকরা বা মেয়েদের ভূমিকায় পুরুষদের দেখতে চায় না। ভবিষ্যতে এই গান টিকিয়ে রাখতে হলে মহিলা ছোকরা, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রীর প্রয়োজন। প্রসঙ্গত বলি, ২০০৯ সালে এক মেয়েকে দিয়ে ছোকরার ভূমিকায় অভিনয় করিয়েছিলাম, যেটা বিটিভি ওয়ার্ল্ড মোট ২৯ বার প্রচার করেছে। এটা আমার আলকাপ-জীবনের একটা বড় পাওয়া। এই গান টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান ও শুভবোধসম্পন্ন মানুষের এগিয়ে আসা জরুরি। যাঁরা দেশের সংস্কৃতির শেকড় ও ঐতিহ্যকে ভালোবাসে, ওই সব মরমি লোককে আমরা আমাদের পাশে পেতে চাই। চাই তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতা। জাতীয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় আমরা আলকাপ করতে চাই। এই গানের প্রচার ও প্রসারের জন্য এটাও জরুরি। এ জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করি। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়, আমার জানামতে, যে কয়জনের দল আছে, তাঁরা হচ্ছেন ১. কেরামত সরকার, ২. জয়চাঁদ সরকার, ৩. জাহাঙ্গীর সরকার, ৪. শফিকুল সরকার, ৫. বীরেন সরকার, ৬. কেতাবুর সরকার, ৭. লুত্ফর সরকার ও ৮. ভিখু সরকার। সাধারণত অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত আলকাপের গানের আসর বসে। বেশির ভাগ আসরই রাতে শুরু হয়। শেষ হতে হতে কখনো সকাল কিংবা দুপুরও পার হয়ে যায়। দুই দল থাকলে এমনটি প্রায়ই হয়। কবিগানের মতো লড়াই জমে ওঠে। খুব মজার কথা যে, এই গান করতে গিয়ে হর্ষ-বিষাদের অভিজ্ঞতাও স্বাভাবিকভাবেই জমা হয়েছে। বিটিভিতে প্রচার কিংবা অজস্র মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছি; তেমনি পেয়েছি বিষাদও। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার পণ্ডিতপুর গ্রামে একবার আলকাপ করতে গিয়েছিলাম। দুই রাত আলকাপ করেছি। কিন্তু বিদায়ের সময় অদ্ভুতভাবে কর্তৃপক্ষ কোনো টাকা-পয়সা না দিয়ে চুপ মেরে গেল। অতঃপর টাকা-পয়সা ছাড়াই আমরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এই আলকাপ গানের শুরু কবে হয়েছিল এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে অবিভক্ত ভারতবর্ষের মালদহের সুবল কানীর একটি গানে আলকাপ গানের প্রথম রচয়িতা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার মোনাকষা গ্রামের বোনাকানার নাম পাওয়া যায়। এখানে আছে—'প্রথম মোনাকষার বোনাকানা/আলকাপ গান করেন রচনা/তার পরেতে সুবেদার আলী ভাই/বাড়ি তাহার মালদহতে হয়/তার পরেতে ঝাঁকসু সরকার নামটি শুনি/তার জঙ্গীপুরে বাড়ি জানি/আলকাপে যে বিখ্যাত রে ভাই/জাগিরুদ্দিন শাহর নাম/তার নূরপুরেতে হয়তো ধাম।' এই আলকাপ গান উত্তরবঙ্গ ছাড়াও বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকসংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের সহযোগিতায় পরিপুষ্ট হয়েছে। উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি টিকিয়ে রাখতে এই গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বহুদিন থেকেই। এর ব্যাপক চর্চা, প্রসার ও প্রচারে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সুস্থ-সচেতন ও শুভবোধসম্পন্ন সংস্কৃতিবান মানুষ এগিয়ে আসবেন—এই আমার আন্তরিক প্রত্যাশা। অনুলিখন: কনকরঞ্জন দাস সার্কাসবীরেনচন্দ্র দাস লক্ষ্মণ দাস মানুষের মনে আনন্দ দেওয়ার ব্রত নিয়ে সার্কাস দল প্রতিষ্ঠা করেন, আমি তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে সার্কাস দেখিয়ে আনন্দ পাই। অপসংস্কৃতির আগ্রাসন ঠেকাতে দেশীয় সংস্কৃতিচর্চার বিকল্প নেই। তাই নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা অক্ষুণ্ন রেখে পল্লি বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা ভুলিয়ে দিতে ৬০ বছর ধরে লক্ষ্মণ দাস সার্কাস নিয়ে ছুটে চলেছি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। এর পোশাকি নাম দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাস পার্টি হলেও মানুষ একে লক্ষ্মণ দাসের সার্কাস নামেই জানে। যখন দেখি মানুষ সার্কাস দেখে আনন্দ পায়, তৃপ্তি বোধ করে, তখনই আমার মনে হয় আমাদের কষ্ট, আমাদের প্রচেষ্টা, আমাদের সাধনা সার্থক হয়েছে। যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন লক্ষ্মণ দাসের সার্কাস নিয়ে দেশজুড়ে মানুষকে আনন্দ দিতে চাই। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার উত্তর পালরদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আমার বাবা লক্ষ্মণচন্দ্র দাস। তাঁর বাবা অশ্বিনীকুমার দাস ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। অশ্বিনী দাসের তিন ছেলে রঘুনাথ দাস, যদুনাথ দাস ও লক্ষ্মচন্দ্র দাস। ছোট ছেলে লক্ষ্মণচন্দ্র দাস ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন হাসিখুশি ও চঞ্চল প্রকৃতির। যৌবনে ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী ও শক্তিবান যুবক। লক্ষ্মণচন্দ্র দাস খেলার ছলে শৈশবের বন্ধুদের নিজস্ব আঙ্গিকে শারীরিক কসরত দেখিয়ে আনন্দ দিতেন। লেখাপড়ায় ছিল খুব অমনোযোগী। তিনি স্কুলে স্কুলে ঘুরে শারীরিক কসরত দেখাতেন। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি কোনো একদিন বাবার শাসনে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তারপর তাঁর মেসোমশাই সাধুচরণ দাসের 'দি সাধনা লায়ন সার্কাস'-এ চলে যান। একজন নবীন শিল্পী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই সার্কাস দেখতে দেখতে নিজে শারীরিক কসরত রপ্ত করে একাধিক খেলা দেখানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তাঁর মেসোমশাই সাধু দাসের সঙ্গে কিছুদিন থাকার পর তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ১৯৪৮ সালে তিনি নিজেই একটি সার্কাস দল গঠনের উদ্যোগ নেন। নিজ গ্রাম উত্তর পালরদী এসে লক্ষ্মণচন্দ্র দাস ৮-১০ জন খেলোয়াড় নিয়ে একটি দল গঠন করেন এবং নিজের নামেই নামকরণ করেন। 'লক্ষ্মণ দাস সার্কাস' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এতে তাঁর ভাইয়েরা তাঁর ওপর বিরাগ হন। তাঁর মেসোমশাই সাধু দাসের সার্কাসে থাকাকালে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা দু-তিনজন সহকারী শিল্পী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। গৌরনদী উপজেলার উত্তর বিজয়পুর গ্রামের ম্যাজিক শিল্পী রাসু ঠাকুর তাঁর সহকারী হিসেবে যোগ দেন। তখন সার্কাসের তেমন কোনো খেলাধুলার উপকরণ কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জীবজন্তু ছিল না। লক্ষ্মণ দাস সার্কাসের যাত্রা শুরুর পর মানুষকে আনন্দ দেওয়ার লক্ষ্যে বিরামহীনভাবে ছুটে যেতেন দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগে ধীরে ধীরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ খেলোয়াড়, পশুপাখি ও খেলাধুলার উপকরণ সংগ্রহের মধ্য দিয়ে পঞ্চাশের দশকে লক্ষ্মণ দাস সার্কাস একটি পূর্ণাঙ্গ সার্কাস দলে পরিণত হয়। লক্ষ্মণ দাস নিজেও সার্কাসে দাঁত দিয়ে রড কাটা, গলা ও চক্ষু দিয়ে রড বাকা করা ও ভারোত্তোলন খেলা প্রদর্শন করতেন। তিনি বরিশাল ব্যামাগারের একজন সদস্য ছিলেন। অল্প সময়ে সুনাম-সুখ্যাতি ও বিসৃ্ততি লাভ করে দেশজুড়ে। দেশের মানুষের কাছে লক্ষ্মণ দাস সার্কাস একটি জনপ্রিয় নাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাবার সার্কাসকে ঘিরেই (লক্ষ্মণ দাসের) পারিবারিক ঐতিহ্য তৈরি হয়। গৌরনদীর দাস পরিবার সারা দেশে একটি সুপরিচিত পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্রমেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। মুক্তিকামী মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার, ঠিক তখন পশ্চিমা হায়েনারা ২৫ মার্চ সেই কালরাত্রির হত্যাযজ্ঞের সময় পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা এলাকায় লক্ষ্মণ দাস সার্কাস নিয়ে সার্কাস প্রদর্শন করছিলেন। দেশ যখন পুরোপুরি সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিষয়টি বুঝতে পেরে লক্ষ্মণ দাস তাঁর সার্কাসের দলবল নিয়ে একাত্তরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিজ বাড়ি গৌরনদীতে ফিরে আসেন। গৌরনদীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবস্থান নিতে আসছে এ খবর শুনে লক্ষ্মণ দাস তাঁর পরিবার পরিজন ও সার্কাসের দলবল নিয়ে গৌরনদী গয়নাঘাট থেকে নৌকাবহরের কিছু নৌকা রেখে বাকি নৌকা নিয়ে বৃহত্তর গৌরনদীর বাকাল ইউনিয়নের কোদালধোয়া গ্রামের প্রত্যন্ত পল্লিতে অবস্থান নেন। বর্তমানে এটি আগৈলঝাড়া উপজেলার অন্তর্গত। সেখানে তাঁর পরিবারপরিজন নিয়ে কোদালধোয়া হাইস্কুলে এবং সার্কাসের লোকজন কোদালদোয়া খালে মিস্ত্রি বাড়ির কাছে নৌকা ভিড়িয়ে আত্মগোপন করে বসবাস শুরু করেন। পশুপাখি নৌকায় থাকলেও সার্কাসের একমাত্র হাতিটি স্কুলের পাশে একটি গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। এ সময় লক্ষ্মণচন্দ্র দাস সার্কাসের কলাকুশলী, শিল্পী, লোকজন ও স্থানীয়দের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। এ সংবাদ স্থানীয় রাজাকাররা গৌরনদী কলেজে পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। একপর্যায়ে হানাদারদের আক্রমণের খবর পেয়ে লক্ষ্মণ দাসের পরিবার ও সার্কাসের লোকজন পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। একমাত্র লক্ষ্মণ দাস সার্কাসের মায়ায় ওই স্থানেই থেকে যান। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন পাকিস্তানি হানাদাররা রাজাকারদের সহায়তায় অতর্কিত গুলি করে সার্কাসের পশুপাখি, জীবজন্তু হত্যা করে। পরে স্কুলের কক্ষ থেকে লক্ষ্মণ দাসকে খুঁজে বের করে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় প্রভুভক্ত একমাত্র হাতিটি গর্জন করে সর্বশক্তি দিয়ে গাছ উপড়ে ফেলে নিহত প্রভু লক্ষ্মণ দাসের লাশের কাছে ছুটে এলে হানাদাররা হাতিটিকে লক্ষ্য করে গুলি করে ঝাঁজরা করে দেয়। হানাদাররা চলে যাওয়ার পর তাঁর স্বজনেরা ফিরে এসে লক্ষ্মণ দাসের লাশ ও প্রভুভক্ত হাতিটিকে মাটিচাপা দিয়ে তাঁর পরিবারের সবাই ভারতে পালিয়ে যান। আমি যাই তিন মাস পরে। ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিই। তবে আমি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাকলেও আমার বাবার নাম নেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। দেশ স্বাধীনের পর লক্ষ্মণ দাসের দুই ভাই ও ছেলে অরুণচন্দ্র দাস, আমি বীরেনচন্দ্র দাস, চূড়ামণি দাস ও বাসকলাল দাস খোকন সার্কাসটি পুনরায় চালু করি। মালিক হিসেবে আমাকে এবং পরিচালক হিসেবে বড় ছেলে অরুণচন্দ্র দাসকে মা নীলা রানী দাস দায়িত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার গৌরনদী উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের নিজাম উদ্দিন আকন রিলিফের তাঁবু থেকে কযেকটি তাঁবু ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। ১৯৭৩ সালে কৃষি সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ সার্কাসের প্যান্ডেল তৈরির জন্য কিছু টিন প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি পাঁচ লাখ টাকা, একটি বাঘ শাবক, একটি ভাল্লুক ও একটি হাতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। ১৫ আগস্টে তিনি শহিদ হন। দেশের পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯৭৬ সালে বরিশালের জেলা প্রশাসক আবদুল হাকিম সার্কাসের হাতি কেনার জন্য ঋণ দিয়ে সহায়তা করেন। আরও অনেকের সহায়তায় আমরা পুরোদমে সার্কাসটিকে চালু করি। ১৯৭৯ সালে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীর আমন্ত্রণে ঢাকায় সার্কাস দেখাই। ওই সময় সরকারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকার অনুদান পাই। ১৯৮০ সালে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পদক প্রদান করা হয়। বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে আমার বড় ভাই অরুণচন্দ্র দাস বাবার কিছু খেলা দেখান। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি খেলা দেখাচ্ছেন। চোখ দিয়ে ও গলা দিয়ে লোহার রড বাঁকা করা, ভারোত্তোলন ও গ্লোব খেলা ইত্যাদি দেখাতে তিনি দক্ষ। এর মধ্যে সবচেয়ে জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ হলো লোহার পাত দিয়ে তৈরি ডিম্বাকৃতির ২০ ফুট ব্যাসের লোহার খাঁচার মধ্যে মোটরসাইকেল চালানো। কখনো কখনো হাত ছেড়ে বার বার চক্কর দেওয়ার একপর্যায়ে মোটরসাইকেল নিয়ে খাঁচার উপরিভাগে ১৬ ফুট ওপরে গিয়ে হুক ধরে ঝুলে থাকা। এই খেলাটি এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে সামান্য ত্রুটিতে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের সার্কাসে বর্তমানে ৪২ জন নারী ও শিশুশিল্পীসহ প্রায় শতাধিক শিল্পী রয়েছেন। এ ছাড়া নৃত্যশিল্পী, দর্শকদের আরও বেশি প্রাণবন্ত ও আনন্দ দিতে জোকার রয়েছে। খেলার মধ্যে রয়েছে মোটরসাইকেল গ্লোব, ত্রিফলা বর্ষা, রিং নৃত্য, রশিনৃত্য, সাইকেল এক চাকা, সাইকেল দুই চাকা, হাই সাইকেল, তার সাইকেল, বাম্বু ব্যালেন্স, তারে যাতায়াত, অগ্নি রিংয়ে জাম্পসহ অসংখ্য খেলা। পশুপাখির মধ্যে রয়েছে বানর, হাতি, বাঘ, ভাল্লুক, ঘোড়া ও গাধা। আকর্ষণীয় ম্যাজিক তো রয়েছেই। দীর্ঘ সার্কাসজীবনে সব সময় সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় আমাদের পড়তে হয় বা হয়েছে তা হলো সার্কাস প্রর্দশনের অনুমতি পাওয়া নিয়ে হয়রানি। শো প্রদর্শনের আগে যখনই আমরা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হই তখন অনেকেই বাড়তি সুবিধা দাবি করে। প্রতিদিন সার্কাসের শিল্পী, কলাকুশলী, কর্মচারী, পশুপাখিদের ভরণ-পোষণ ও বেতনে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। অনুমতি না পাওয়ায় সার্কাস বন্ধ থাকলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। বর্তমানে এর সঙ্গে আরও একটি সমস্যা যোগ হয়েছে—তা হলো সার্কাসের শো প্রদর্শন করতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ ব্যবহার করতে না দেওয়া। এ সমস্যার কারণে আমরা অনেক সময় সার্কাস দেখাতে পারি না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অনুমতি নিয়ে হয়রানি না হলে রমজান মাস বাদ দিয়ে আমরা বছরে ১১ মাস সার্কাসের শো করতে পারি। সার্কাস বন্ধ থাকলে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা লোকসান হয়। সার্কাস শুরুর পর দীর্ঘ ৬২ বছরে সবচেয়ে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল জোট সরকারের সময়ে। দেশে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হলে সার্কাস প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় শো বন্ধ করে দিয়ে বসে বসে কলাকুশলী, পশুপাখি ও কর্মচারীদের পকেটের টাকা খরচ করে মাসের পর মাস পালতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, সার্কাস বন্ধ থাকায় খেলার উপকরণও বিনষ্ট হয়। অনুশীলন না থাকায় পশুপাখি তাদের প্রশিক্ষণ নেওয়া খেলা ভুলে যায়। গ্রামীণ মানুষের নির্মল বিনোদনের এই মাধ্যমটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। অনুলিখন: জহুরুল ইসলাম পুতুলনাচনজরুল ইসলাম বাবার পুতুলনাচের দল ছিল। নাম রূপসী বাংলা পুতুলনাচ। বাবা নিজেই পুতুল-মাস্টার ছিলেন। তিনি পুতুল নাচাতেন। পুতুল হাসে, পুতুল ফাঁদে। পুতুল গায়, নাচে আবার নাটকের মতো অভিনয়ও করে। বিষয়টি শৈশবে আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হতো। তখন দেশ স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তান আমল। আমাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে। প্রথমে বাবার নামের সঙ্গে দলের পরিচিতি আসে। আশপাশের গ্রামের লোকজনের কাছে 'রূপসী বাংলা পুতুলনাচ' দলটি মকবুল মাস্টারের দল হিসেবে পরিচিত হয়। এরপর আমি দল গঠন করি 'দি নিউ স্টার সোনালী ঝুমুর ঝুমুর পুতুলনাচ' নামে। কিন্তু লাইসেন্স করার সময় শুধু 'নিউ সোনালী ঝুমুর ঝুমুর পুতুলনাচ' নামটুকু রাখি। এই নামে ২৭ বছর চালিয়ে আসছি। সুনামও পেয়েছি। এখানে বলে রাখা ভালো, আমার দল আর বাবার দলের মধ্যে একটা বিস্তর ফারাক রয়েছে। আমি এখন ১২ জন কর্মী নিয়ে দল চালাচ্ছি। সুতোয় টানা পুতুল নাচাই। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে অর্গান, ড্রামসেট, জুড়ি ব্যবহার করছি। কিন্তু ওই আমলে (পাকিস্তানি আমলে) আমার বাবার দলে সুতোয় টানা তারের পুতুল এবং দস্তানা পুতুলের নাচ হতো। বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় থাকত হারমোনিয়াম, জুড়ি, বাংলা ঢোল, বাঁশের বাঁশি এবং খমক-খঞ্জুরি। এখানকার মতো প্যান্ডেল করে টিকিট কেটে তখন পুতুলনাচের আসর বসত না। আমার দল গঠনের আগে বাবার দলে যখন পুতুল নিয়ে খেলতাম (পুতুল নাচাতেন) তখন আসর বসত গ্রামের কোনো মোড়ল-মাতবরের বাড়ির আঙিনায়। হিন্দু অঞ্চল হলে মন্দিরসংলগ্ন চত্বরে। সেখানে প্রচুর লোকজন আসত। শিশু, যুবা থেকে বৃদ্ধরা পর্যন্ত। পুতুলের হাসি, কান্না, নাচ দেখে তারা খুব মজা পেত। আর আয়োজন হতো পাউতি ধরে (টাকার একটি অংশ) আর তোলা তুলে (মাঙ্গন বা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বউ-ঝিদের কাছ থেকে চাল, ডাল, আনাজ-তরকারি তুলে)। এতে পুতুলনাচ দেখিয়ে শুধু টাকাই পেতাম না, চতুষ্পাঠী পণ্ডিতদের মতো উপঢৌকন পেতাম; চাল, আনাজ-তরকারি পেতাম। একবার মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানার খালপাড়ে পুতুলনাচ দেখাতে গেছি। গ্রামের পশ্চিম মাথায় পুতুলনাচ দেখানোর পর ডাক এল পূর্ব মাথায়। সেখানে দেখানোর পর গ্রামের এক মাতবর এসে আব্দার করলেন তাঁর বাড়িতে পুতুলনাচ দেখাতে হবে। বললাম, গ্রামের দুই মাথাতেই তো দেখলেন। আবার কেন? লোকটি বললেন, এটা আমার ইজ্জতের ব্যাপার। এর সঙ্গে আমার মানসম্মান জড়িয়ে রয়েছে। পরে জেনেছিলাম, লোকটি ছিল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। আর একবার পুতুলনাচ দেখাতে গেছি খুলনার বুড়ো ফকিরের থানে। মানিকগঞ্জের বলরাম রাজবংশীর বিশ্বরূপা পুতুলনাচ দল আগেই পৌঁছে গেছে, আমরা জানি না। আমরা যাওয়ার পর থানে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। ভাবলাম আমরা ফিরে আসব। ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর মধ্যে মুরব্বিরা এলেন। তাঁরা থানের থেকে মাইলখানেক দূরে গ্রামে প্রবেশমুখে আমাদের পুতুলনাচের কথা বললেন। বাবা ছিলেন আমার দলে। তিনি অসম্মতি জানালেন। তাতে থান ও বুড়ো ফকির মাজার কমিটির লোকজন আমাদের অনুনয়-বিনয় করতে থাকে। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও এসে গেছেন। তিনি অনুরোধ করে গ্রামে ঢোকার পথেই পুতুলনাচ দেখাতে বললেন। জানালেন, 'এই থানের মেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে পুতুলনাচ। আপনারা চলে গেলে একদিকে ঐতিহ্য নষ্ট হবে, অন্যদিকে আমাদের দুর্নাম হবে। ইজ্জত যাবে।' একসময় পুতুলনাচ দেওয়াটা মানসম্মান-ইজ্জতের ব্যাপার ছিল। এক গ্রামে পুতুলনাচ হয়েছে, অন্য গ্রামে তা দেখাতেই হবে। তখন গ্রামে পুতুলনাচ দেওয়ার জন্য বাড়ির বউ-ঝিরা আব্দার করতেন। আর পুুতুলনাচ দেখে শিশু থেকে শুরু করে থুরথুরে বুড়োরা পর্যন্ত আনন্দে মেতে উঠতেন। এই মুহূর্তে একটা কথা মনে পড়ছে। একবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার কানসাট গেছি পুতুলনাচ দেখাতে। ভাদ্রসংক্রান্তি মেলা উপলক্ষে। আমরা হেমেন্দ্র কুমার নাট্যমঞ্চে পুতুলনাচ দেখাচ্ছি। পাশেই একটি প্যান্ডেল। যশোর থেকে দল এসেছে। গনেশ অপেরা। ভালো নামডাকের দল। কিন্তু রাতে ঘটল কি—একদল লোক যাত্রাগানের ভেতর অধিক নাচগানে আপত্তি তুলে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা যাত্রার সমঝদার দর্শক। কিন্তু ওই রাতে যাবেন কোথায়? শেষ পর্যন্ত তাঁরা এসে পুতুলনাচের দাবি জানান। অত রাতে পুতুলনাচ! আমি তো অবাক! স্থানীয় লোকজনের অনুরোধে আমরা পুতুলনাচের ব্যবস্থা করি। সে রাতে 'রূপবান' পালার নাচ দেখাই। এই পালার অভিনয় দেখাতে অনেকগুলো পুতুল লাগে। তখন দলে অনেকগুলো, হরেক রকম পুতুল থাকত। এখন আর অত লাগে না। এখন এই শিল্পের কদর কমেছে। গ্রামে আর আগের মতো পুতুলনাচের আয়োজন হয় না। এখন মেলা-পার্বণ উপলক্ষে কোনোরকমে টিকে আছে শিল্পটি। আগের নিয়মে পুতুলনাচ প্রদর্শনীর কথা আর ভাবাও যায় না। এখন দর্শনীর বিনিময়ে পুতুলনাচ হয়। কোথাও ১০ টাকার টিকিট, আবার কোথাও তারও বেশি ২০ টাকায় টিকিট বিক্রি করা যায়। প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়টি শো করা যায়। এক একটি শোতে গোটা পঞ্চাশেক লোক আসে। তাতে খরচ বাদ দিয়ে তেমনটা আর থাকে না। ১২ জন স্টাফ বেতন, টিকিট ছাপা, প্যান্ডেল তৈরি করা, মঞ্চ বাঁধা—এতে যে খরচ যায়, তা পোষানো দায়। এ ছাড়া প্রচারের খরচটাও এখন কম যায় না। ইদানীং নাচের প্রচলন ঘটেছে। পুতুলনাচের আসরে এ এক বিড়ম্বনা। কিন্তু নাচ না থাকলে শহুরে দর্শক আসবেই না। গ্রামের মেলা আর শহুরে মেলার মধ্যে পার্থক্য অনেক। ফলে আমরা পুতুলনাচের মালিকেরাও চালাক হয়ে গেছি। দর্শক ডেকে দুই-তিনটা নাচ-গান দিয়ে, শেষে চার-পাঁচটা পুতুল এনে সামান্য নাচাই। এতে সময় বাঁচে, শো বেশি করা যায়, আবার সূত্রধরেরও শ্রম কম যায়। বাদ্যযন্ত্র যারা বাজায় তাদের অবশ্য কষ্ট একটু বেশিই হয়। তা হোক। টাকা একটু বেশি দিয়ে পুষিয়ে দিই। এর ফলে পুতুলনাচের আসরে আগে যেভাবে যাত্রার অংশবিশেষ করতাম তা এখন আর করতে পারি না। আগে রূপবান, লাইলি মজনু, রাখাল বন্ধু, মহুয়া, বেহুলা সুন্দরী, সত্ মা চরিত্র যাত্রার অংশ দেখাতাম। এখন একটা বাউলগান, নৌকাবাইচ, সাপখেলা, বরবধূ—এই জাতীয় জোড়াতালির অনুষ্ঠান দিয়ে শেষ করে দিই। বুঝি, এও এক প্রকার প্রতারণা। তবু সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে গিয়ে করতে হচ্ছে। টেলিভিশনে পাপেট শো দেখি। ভালো লাগে। কিন্তু ওতে দর্শকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কোথায়? আমাদের যদি সরকারিভাবে নেকনজরে দেখা হতো, তাহলে পুতুলনাচ আবার আগের অবস্থানে ফিরে যেত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বানী বীণা, সাতক্ষীরার নিউ রংমহল পুতুলনাচ দলে সুতোয় টানা পুতুলের নাচ-গান মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। সূত্রধরের অপূর্ব টেকনিক আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু নাচের নগ্নতায় বড়ই ব্যথিত হয়েছি। আমার বাবার সঙ্গে পুতুল নাচাতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধনমিয়া সরদারের রয়েল বীণা পুতুলনাচের দলের সঙ্গে মেলায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। তখন কোনো রকম নাচ-গান করতে হয়নি। কোনো কোনো প্যান্ডেলে একজন শিশুশিল্পীর পর্যায়ের কাউকে দিয়ে একটা সংগীত পরিবেশন করে নিতাম। এরপর পেছনের বক্সমঞ্চ থেকে (গ্রিনমঞ্চ) সামনের উদ্যান মঞ্চে (মূল মঞ্চ) পুতুলের প্রবেশ ঘটাতাম। এটা করতাম পাকিস্তানের শেষ দিকে এসে। এর আগে সামনের উদ্যানমঞ্চখ্যাত এই মঞ্চটির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এটা ধীরে ধীরে বাধ্যতামূলক মঞ্চে পরিণত হয়েছে। শুধু মেয়েদের নাচ-গানের জন্য। আমরা এই জাতীয় নাচগান বর্জন করতে চাই। তার জন্য সেই রকম পরিবেশ চাই। লোকশিল্প নিয়ে লোকমানসের সঙ্গে মিশে কাজ করতে চাই। পুতুলনাচ আবার গ্রামে ফিরে যাক—এটাই কামনা। স্কুল, মন্দির, বারোয়ারিতলা, গ্রামের মাতবরদের দহলিজ কিংবা চৈত্রসংক্রান্তি, মহরম, পয়লা বৈশাখসহ গ্রামীণ মেলাতে থেকে পুতুলনাচের চর্চা করতে চাই। আমার দলের সূত্রধর দুজন, বিপ্লব ও ফরিদা, অন্য কোনো কাজ জানে না। ওরা যাত্রাশিল্পীদের মতো সামনের মানুষ না। ওরা পেছনের মানুষ। ওদের কেউ দেখে না। দেখে ওদের হাতের আঙুলের কারুকার্য। শোনে ওদের চটার বাঁশি কিংবা পাতার বাঁশির ডাক, গান, কথোপকথন। একসময় বছরজুড়ে পুতুলনাচ দেখাতে পারতাম। এখন ছয় মাস পারি না। ফলে ওরাও ছয় মাসের মতো ছুটি পায়। তা বলে ওদের বাঁশির ডাক, হাতের টেকনিক কিন্তু ওরা ভোলে না। কাজ শুরু হলে দলে এসে ঠিকই পুতুল নাচায়। একটা একটা করে পুতুলের পোশাক পাল্টায়। একই পুতুল শুধু পোশাকের গুণে ভিন্ন রূপ পায়। একটু আগে যে ছিল রাজা; মুহূর্তে পোশাক পাল্টে দিয়ে তাকে সাজানো হচ্ছে প্রজা। অনুরূপ রানিকে বানানো হচ্ছে দাসী। তবে সুতোয় টানা তারের পুতুলের পোশাক থাকে পূর্ব নির্ধারিত। যে অনুষ্ঠানে যে জাতীয় পালা হোক, গান হোক কিংবা নৃত্য, যুদ্ধ হোক—পুতুলের সেই চরিত্রানুযায়ী সাজপোশাক পরানো থাকে। আমার দলে এখন ২৫টির মতো পুতুল আছে। সবগুলো অনুষ্ঠানে কাজে লাগে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পুতুল এবং এর উপকরণ সবকিছুরই দাম বেড়ে গেছে। যার ফলে আমরাও খুব সতর্ক থেকে পুতুল নাচাই। যাতে সহজে পুতুলের মুখাবয়বের রং না চটে, পোশাক সহজে ময়লা না হয়। মোট কথা, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে পাল্লা দিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে। অনুলিখন: এমএ মজিদ পটচিত্রশম্ভু আচার্য ৪৫০ বছরের পুরোনো আঁকিয়ে আমাদের আচার্য পরিবার। আমার বাবা সুধীর আচার্য। মা কমলা দেবী। জাতি-গোত্র ব্রাহ্মণ, লগ্ন আচার্য। পেশা পঞ্জিকা দেখে বিয়ে বর্ণনা করা। জ্যোতিষকর্ম আর পূর্বপুরুষেরা নির্মাণ করতেন প্রতিমা, আলপনা। দিনবদলের সঙ্গে তাঁরাও বদলালেন বিভিন্ন সময়ে নানা পেশায়। আমি বাবার বড় ছেলে। আমার ছেলে অভিষেক আচার্যও আঁকে। ৪৫০ বছরে যা হয়নি, আমার জীবনে তা ঘটেছে সাধনার বর রূপে। ৪৫০ বছর আগে আচার্যের প্রথম পুরুষ পট আঁকাকে পেশা করেছিলেন। তখনকার পটচিত্র ছিল সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিক। সময়ের পরিবর্তনে তাঁরা একদিন হয়ে ওঠেন পটুয়া। সনাতন ধর্ম আর সহজাত লোককৃষ্টির বিষয় নিয়েই ছিল পটচিত্রের অন্যতম আকর্ষণ। এভাবেই শিল্পের আত্মবিশ্লেষণ পটে সত্য ও বাস্তবে রূপ নেয়। আমাদের বাংলার 'লোক' ফোক আর পুরাণ হাজার বছরের চিরায়ত কৃষ্টি, যা যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে। এসব শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের যে আদিলগ্ন পরিসর, তারই একটি ধারা এই পট। পরবর্তী সময়ে চমৎকার পরিবেশনার ভেতর দিয়ে গ্রামবাংলার জনমানুষের জনপ্রিয় ও সামাজিক চাহিদা পূরণ করার একটা অবস্থান ক্রমশ গড়ে ওঠে। নিজস্ব সত্তার আত্মপরিচয়ে ধারাবাহিক একটা চরিত্র গড়ে উঠতে থাকে এসব পটচিত্রে, যা আজ কৌশলগত ধারায় নিজেকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। এই চিত্রে যেমন আছে বাস্তব জীবনের সংলগ্নতা, তেমনি অন্য প্রান্তে গড়ে উঠেছে সাধিত স্বপ্নের প্রাসঙ্গিক ভাবনা। আমি ছয় বছর বয়সে বাবার সঙ্গী হয়েছি। দিন গেছে চর্চা, সাধনা আর দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে। পটচিত্রকে এই সময়ে পরিচিত করতে পেরে নিজেকে আমি ভাগ্যবান বলে মনে করি। মনে পড়ে পূর্বপুরুষের কথা। জানামতে তাঁরা নয় পুরুষ পট আঁকিয়ে। পূর্বপুরুষ নরসিংদী থেকে মুন্সিগঞ্জের কমলাঘাট রিকাবি বাজারের পাশের কালিন্দিপাড়ায় বসবাস করতে থাকেন। এঁদের প্রথম আদি পেশা ছিল তাঁতের শাড়িতে নকশা করা। পরে প্রতিমা তৈরি এবং পটচিত্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। মনে রাখা যায়, পটচিত্র নতুনভাবে তৈরি হয় না, বংশক্রমান্নয়ে এটা গড়ে উঠছে। এখন অনেকেই পটচিত্র আঁকেন, এটা একটা ভালো লক্ষণ। কঠিন নিয়ম মেনে পটচিত্র আঁকতে হয়। শিশিরভেজা সকালে গোসল করে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে মন্ত্র পরে ধ্যানমগ্ন হতে হয়। পরবর্তী সময়ে ফোটানো জলের সঙ্গে দেশীয় বানানো রং মিশিয়ে ক্যানভাসে প্রয়োগ করতে হয়। অপবিত্র অবস্থায় বা ইচ্ছা করলেই যখন-তখন আঁকা সম্ভব নয়। এই চিত্র আঁকার কিছু নিয়মতান্ত্রিক ব্যাকরণ আছে, যা মেনে এবং শিখে এসব পটচিত্র আঁকতে হয়। ফোক-লোক আচার-কৃষ্টির বিষয় গ্রামবাংলার আবহমানকালের জনমানুষেরই প্রকৃত উৎসব অনুষ্ঠান, যা পরম্পরায় বিভিন্ন পথ ধরে এসেছে নানা মাধ্যম হিসেবে। দুই বাংলায় পটচিত্রে কিছুটা ভিন্নতা আছে। তবু পটচিত্রের আদিবিষয়কি সম্পর্ক দুই বাংলায় খুব কাছাকাছি। ইউরোপিয়ান কোনো চিত্রের সঙ্গে পটচিত্রের কোনো মিল নেই বা কোনো প্রভাব নেই। এটা বাংলার মূল সংস্কৃতির ধ্রুপদী দিকনির্দেশনচিত্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। পটচিত্রের স্বধর্মই বাস্তবকে রূপান্তরিত করা। প্রাকৃতিক ও সাদৃশ্যবোধক লক্ষণগুলো দেশীয় তাৎপর্য নিয়ে মানসিক স্তরে পৌঁছে দেওয়া। স্মৃতি ইচ্ছা কল্পনার চেতনে-অবচেতনে প্রসারিত হতে থাকে নিরবধি। ঠিক তেমনি রূপকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে একটি অনির্বচনীয় বোধ জেগে ওঠে। সম্ভবত এ কারণেই চেনা কিছুকে অচেনা মনে হয়। এই অচেনা অপরিচয়ের অনুভূতি একদিকে যেমন স্থির, অন্যদিকে লৌকিক অর্থে একাধিক সংকেতের সম্ভাবনা গড়ে তোলা। পটচিত্র তাঁর বিষয়ের দিক থেকে পরিষ্কার ও অর্থবহ। এই শিল্প দেশীয় কৃষ্টির ধ্রুপদী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক, এই আমার প্রত্যাশা। অনুলিখন: মাহবুব কামরান ধাতু-তক্ষণসুকান্ত বণিক আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বংশাই নদী। এই নদীর জলে সাঁতার কেটে পার হয়েছে আমাদের শৈশব। সেই শৈশব আজও যেন পেতলের একটি বেল্ট দিয়ে বাঁধা—তবে একদিন পেতলের ওই বেল্টটিকে যে লুকিয়ে রেখেছিলাম ছেলেবেলার খেলার অবসরে, সেই বেল্টটি আমি আজও পাইনি। আজ রাধা-কৃষ্ণ, গণেশ, শিব, মনসা আর বুদ্ধমূর্তি তৈরিতে সময় কেটে যায়। যখন অবকাশ মেলে, আমার পেতলের বেল্টটিকে বারবার খুঁজে ফিরি। বেল্টটি এখন বংশাই নদীর মতোই মৃত। কিন্তু মানুষের ছেলেবেলার কি মৃত্যু ঘটে? কাজের ফাঁকফোকরে কেন যেন স্মৃতি হয়ে হানা দেয় আমার ছেলেবেলা, আমার সেই হারানো বেল্ট। এই যে আমি সুকান্ত বণিক, ৩৭ বছর বয়সে পৌঁছে ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখি, কাঁসা-পেতল, মোমের গন্ধ, ঢালাইয়ের কাজ আর পেতলের মূর্তির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে করতে কবে যেন বড় হয়ে গেছি! ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের পরিবার কাঁসা-পেতলের শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ঠিক কবে বা কে প্রথম আমাদের পরিবারকে এই মেটাল শিল্প-অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করেন, তার সঠিক লেখাজোখা আজ আর পাওয়া যাবে না। তবে পাঁচ প্রজন্মের বংশলতিকার হিসাব শনাক্ত করে এটুকু বলতে পারি, এই শিল্প-ঘরানার সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ২০০ বছরের কম নয়। সেই যে লালবিহারী বণিক, শরত্চন্দ্র বণিক, সর্বমোহন বণিক এবং আমার বাবা ফণীভূষণ বণিক—পূর্বপুরুষের এই সমৃদ্ধ পরম্পরার মাধ্যমে কাঁসা-পেতলের কারুশিল্পের সঙ্গে আজ জড়িয়ে আছে আমার ক্ষুদ্র নামটিও। ১৯৭৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আমার জন্ম। যখন এতটুকুন ছিলাম, সে থেকে দেখে আসছি, আমাদের দোতলা বাড়ির এক কোণে আপন মনে কাজ করে চলেছেন বাবা-জেঠারা। কখনো তাঁরা মোমের সাজি তৈরি করছেন, সেই সাজির ওপর সাজাচ্ছেন মাটির প্রলেপ, আবার আগুনে পোড়ানোর পর তাতে পেতলের ঢালাই দিচ্ছেন পরম মমতা আর গভীর নিষ্ঠায়—এভাবেই কাঁসা-পেতলের গন্ধময় এক ভুবনে গায়ে বংশাই নদীর জল মেখে আমি বেড়ে উঠেছি। ১৯৮৪-৮৫ সাল হবে। এক সাদা মেমসাহেব বাবার শিল্পকর্মে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একটি রঙিন টেলিভিশন উপহার দিলেন। টেলিভিশন সে সময় আমাদের কাছে বিশাল ব্যাপার, বিরাট আনন্দদায়ক ঘটনা। তবে এই ছোট্ট ঘটনাটির মধ্য দিয়েই সেদিন আমার কৈশোর-উত্তীর্ণ মন বুঝেছিল এই শিল্পের মহিমা। পুরোপুরি না হলেও অন্তত এটুকু সেদিন সে বুঝতে পেরেছিল যে এই শিল্পের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্যদের মুগ্ধ-বিস্ময়াবিভূত করতে পারে। তবে পারিবারিক এই পেশার সঙ্গে পরবর্তীকালে আমার জীবন জড়িয়ে যাবে—এমন ভাবনা মাথায় আসেনি সেদিন। কাঁসা-পেতলের শিল্পের সঙ্গে আমি নিজেকে যুক্ত করেছি নিতান্ত পারিবারিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে। '৯৩-এ জেঠা সাক্ষীগোপাল বণিকের মৃত্যু হলো। আমাদের পরিবারে নেমে এল তীব্র অনটন। সেই দুর্যোগমুহূর্তে আমার বাবা ফণীভূষণ বণিক তাঁর পৈতৃক ব্যবসায় দেখছিলেন শুধু লোকসানের অঙ্ক। বস্তুত প্রযুক্তির নানা উত্কর্ষ ও আধুনিকায়নের ফলে কাঁসা-পেতলের প্রাচীন শিল্পটি জনরুচিতে তত দিনে 'সেকেলে' হয়ে যাচ্ছিল। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শ্রমিক হিসেবে সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য ঘোরাঘুরি করলাম কিছুদিন। কিন্তু ভাগ্যদেবী ছিলেন অপ্রসন্ন। অবশেষে কাঁসা-পেতলের পারিবারিক ব্যবসা নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য বাবার গদিতে বসতে হলো। তখন ভাবনায় এল, ঐতিহ্যকে ঠিক রেখে কীভাবে এই শিল্পকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তোলা যায়। এ সময় আমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমেরিকান নাগরিক মাথিও এস ফ্রিডমেনের। এন্টিক সংগ্রাহক এই মানুষটি আমাদের কাঁসা-পেতল শিল্পকর্ম দেখেন, মোহিত হন এবং এই শিল্পের শৈল্পিক-বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন আমাকে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ মেটাল কস্টিং: ফাইভ টেকনিক নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি। মূলত তাঁর মাধ্যমেই আমেরিকায় পৌঁছে গেল ধামরাইয়ের কাঁসা-পেতলের শিল্প। কাঁসা-পেতলের তৈরি বুদ্ধমূর্তি কিংবা রাধা-কৃষ্ণ মূর্তির ঠাঁই মিলল যুক্তরাষ্ট্রের সাদা দালানকোঠায়। এরপর হয়তো সাফল্য এসেছে। সরস্বতীর পাশাপাশি দেখা মিলেছে লক্ষ্মীরও। বংশাই নদীতীরবর্তী অখ্যাত জনপদ ধামরাই খ্যাত হয়েছে কাঁসা-পেতলের হলুদাভ আলোয়। আর সেই আলোর ঝলকানি স্পর্শ করে, আমেরিকান দূতাবাসের আমন্ত্রণে ২০০২ সালে আমেরিকার ১০টি রাজ্য ঘুরে ঘুরে দেখেছি ওদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য। কাঁসা-পেতলের শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ ক্রাফট কাউন্সিলের ব্যবস্থাপনায় ২০০৭ সালে নেপালি শিল্পীদের সঙ্গে সংস্কৃতি বিনিময় কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়েছি হিমালয়কন্যার সেই দেশে। এত সব সম্মাননার মধ্যেও বুকে খেদ থেকে যায়। কি আমেরিকা, কি নেপাল—ওদের লৌকিক ঐতিহ্যের চেয়ে আমাদের বাংলাদেশের কাঁসা-পেতলের শিল্পের ঐতিহ্যমূল্য কোনো অংশে কম নয়। এই শিল্প অনেক ক্ষেত্রে আমার দেশের শৈল্পিক ও ঐতিহ্যিক মহিমাকে আরও ওপরে তুলে ধরে। যদিও আমাদের এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি আজও পুরোপুরি শিল্পের আকার পায়নি। আক্ষেপ এই, কাঁসা-পেতলে তৈরি এই নান্দনিক শিল্পকর্মের অধিকাংশ ক্রেতাই বিদেশি। দিনমান শ্রম ও ঘামে আমরা যে মূর্তিগুলো মূর্ত করে তুলি, শেষাবধি তা শোভা পায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে। আমাদের দেশে বিপুল অর্থ খরচ করে বিভিন্ন শৌখিন শিল্পদ্রব্য কেনার বিষয়ে আগ্রহী মানুষ কম নেই। অথচ মেটালে প্রস্তুত করা আমাদের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকর্ম ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। এখানে বলে রাখা ভালো, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপালেও কাঁসা-পেতলের শিল্প রয়েছে। তবে ওদের সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্য এই, একই ডায়েস বা ছাঁচ দিয়ে ওরা অসংখ্য শিল্পকর্ম তৈরি করে। কিন্তু আমাদের পদ্ধতিটি একেবারেই ভিন্ন—হস্তনির্ভর। আমরা একটি ছাঁচ দিয়ে একটি মাত্র শিল্পকর্মই প্রস্তুত করি। ফলে কাঁসা-পেতলের শিল্পে আমাদের নান্দনিকতা অন্যদের চেয়ে সমৃদ্ধ। আমার পেতলের বেল্টটি হারিয়ে গিয়েছিল একদিন। সেই বেল্টের স্মৃতি বুকে নিয়ে বারবার স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন ভেঙে যায়। আজ চার বছর ধরে কাঁসা-পেতলের শিল্প রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সরকার যদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে এই সম্ভাবনাময় শিল্পের ব্যাপারে একটু সদয় হয়, বিভিন্ন বাণিজ্য মেলায় যদি মেটাল শিল্পের জন্য পৃথক কর্নারের ব্যবস্থা রাখা যায়, তবে দীর্ঘকাল বাহিত এই কাঁসা-পেতলের শিল্পের সুষমাও ছড়িয়ে পড়তে পারে দশদিগন্তে। অন্যদিকে কাঁসা-পেতলের শিল্পের কাঁচামাল আমাদের অগোচরেই পাচার হয়ে যায়। এই শিল্পের প্রতিষ্ঠার জন্য পাচার রোধ করাও জরুরি। আমি এক অভাজন। সম্বলও তেমন নেই—স্বপ্ন ছাড়া। দুচোখে তাই মুঠি মুঠি স্বপ্ন লেগে আছে। সেই স্বপ্নে দেখতে পাই, একদিন যে বালক তার পেতলের বেল্টটি হারিয়ে ফেলেছিল, যে বেল্টটি সে খুঁজে চলেছে আশৈশব—পেতলের সেই বেল্টের বদলে এখন সে তাকিয়ে আছে অসংখ্য অনিন্দ্য কাঁসা-পেতলের মূর্তির দিকে। যে মূর্তি লৌকিক বাংলার শৌর্য-গৌরবকেই মূর্ত করে তুলছে বারবার, বিশ্বের অবারিত আকাশে। নীলু ঠাকুর অষ্টাদশ - উনবিংশ শতক
|
কবি নীলু ঠাকুর - হরু ঠাকুর ও রাম বসু প্রভৃতির পরবর্তী কবিওয়ালাদের মধ্যে অন্যতম | ইনি প্রথমে হরু ঠাকুরের দলে ছিলেন, পরে নিজের নামে দল বাঁধেন | নিজের দল বাঁধার পরও হরু ঠাকুর তাঁকে গান রচনা করে দিতেন | নিলু ঠাকুরের এক ভাই ছিলেন | তাঁর নাম রামপ্রসাদ | রামপ্রসাদও ভাইয়ের কবির দলে থাকতেন | সেই কারণে এই দল 'নিলুরামপ্রসাদি দল' নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল | নিলু ঠাকুরের নিজের রচিত গান বড়ো ছিল না | প্রসিদ্ধ কবিগানের বাঁধনদার কৃষ্ণমোহন ভট্টাচার্য তাঁর দলের গান রচনা করে দিতেন |
. --- উত্স: দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত "বাঙালীর গান" ১৯০৫ .
| |
|
|
No comments:
Post a Comment