ঘরের মধ্যে ঘর বেঁধেছেন – লালন ফকির
ঘরের মধ্যে ঘর বেঁধেছেন
মন মতো মনোহরা।।
ঘরের আট কুঠুরী নয় দরজা
আঠাম মোকাম চৌদ্দ পোয়া
দুই খুঁটিতে পাড়া সুসারা।।
ঘরের বায়ান্ন বাজার, তেপান্না গলি
ঐ বাজারে বেচাকেনা
করে মনচোরা।।
ঘরের মটকাতে আছে
নামটি তার অধরা।
ফকির লালন বলে, ঐ রূপে নিহার রাখে
অনুরাগী যারা।।
লালন ফকির ও কতিপয় গুরুতর প্রসঙ্গঃ পর্ব-২
০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১১:৪২
প্রথম পর্ব
লালনকে নিয়ে দ্বিতীয় একটি সমস্যা আছে, যা শুধু প্রবল কি প্রকট নয়, রীতিমত বিপজ্জনকও বটে। কেউ কেউ লালনকে বলেন, আউলিয়া। খুবই বিপদ যে, এই ধরণের গবেষকদের প্রলাপোক্তির কোন সীমা পরিসীমা নেই। যে ব্যক্তি জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়েন নি, একটি রোজা রাখেন নি, যিনি চৈত্র-মাসের দোল পূর্ণিমাকে গ্রহণ করেছেন তার বাৎসরিক পূণ্যযজ্ঞের মাহেন্দ্র রজনীরূপে, যিনি যাপন করেছেন ইসলামের সঙ্গে গুরুতরভাবে সম্পর্করিক্ত এক মুশরেকী জীবন, যার শিষ্য প্রশিষ্যদের আধ্যাত্নিক সাধনার শ্রেষ্ঠতম অনুপান গঞ্জিকা(গাঁজা)-তিনিও একজন আউলিয়া। আউলিয়াই বটে। কোন কোন গবেষকের প্রেম ও কল্পনা শক্তি যে সত্যই বড় প্রবল, এটা তারই প্রমাণ।
জন্মসূত্রে লালন কী ছিলেন এ নিয়ে কিছু সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু তার জীবনাচারে যে ইসলাম ও মুসলমানিত্বের গন্ধমাত্র ছিল না, এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তবু তাকে আউলিয়া দরবেশ অভিহিত করে কিছু কিছু গবেষক কী যে তৃপ্তি ও সুখ ও ফায়দা লাভ করেন, আল্লাহপাক জানেন। এবং পন্ডিতজনেরা কিন্তু যথেষ্ট সাফল্যও লাভ করেছেন; কারণ অবস্থা অতিদ্রুত এমন রূপ পরিগ্রহ করেছে যে, গঞ্জিকাপায়ী সংসার পলাতক কিছু লালনভক্ত শুধু নয়, বহু সাধারণ মুসলমানও বিশ্বাস করে, লালন একজন খুবই বড় মাপের আউলিয়া ছিলেন। বদনসীব, বাঙ্গালী মুসলমানদের সত্যই বড় বদনসীব।
বর্তমান লালনপ্রেমীদের খুব কষ্ট হবে, তবু দু একটি বিষয়ে আলোকপাত করা বিশেষ জরুরী। প্রকৃত পক্ষে লালনের যথার্থ পরিচয় অতভাবে বিধৃত হয়ে আছে তার সমসাময়িক ও তৎপরবর্তী প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর ইতিহাস এবং তার গানের মধ্যে। লালনকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি শুরু হয়েছে পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালের পর। সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথের প্রতিপ হিসেবে দাঁড় করানোর একটি নিরর্থক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যলালিত লক্ষ্য নিয়েই এই বিকৃতি প্রক্রিয়ার শুরু। এবং আজকের আমরা যে লালনকে দেখতে পাচ্ছি, সেটা অংশত ওই প্রক্রিয়ারই পরিণতি। তবে বর্তমান প্রবন্ধে এ নিয়ে আলোচনার বেশী অবকাশ নেই কারণ বর্তমান লেখাটির প্রতিপাদ্য একটু ভিন্ন।
লালন কিভাবে ও কতখানি বিপজ্জনক ছিল এবং এখনো যে বিপদ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সমস্যাটি তুলে ধরাই বর্তমান আলোচনার মূল লক্ষ্য। সমস্যাটা হলো, লালন মুসলমান ছিলেন না মুমেনও ছিলেন না এবং আউলিয়া হওয়ার তো কোন প্রশ্নই উঠে না; অথচ এই সকল অভিধায় আজ তাকে অভিহিত করা হচ্ছে। যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে, ইসলামের জন্যে নিভূ নিভূ হলেও কিছুটা অন্তত প্রীতি আছে, তার পক্ষে এসব অকথ্য মিথ্যাচার সহ্য করা কষ্টকর।
লালনকে এখন আদর করে বলা হয় বাউল সম্রাট। আমাদের কোন আপত্তি নেই; আমরা বরং এই ভেবে খুশীই যে, আমাদের এই দরিদ্র দেশে এমন একজন সম্রাটের জন্ম যার গানের ছত্রছায়া এখনো আমাদের উপর ছায়া বিস্তার করে আছে। কিন্তু কেউ অস্বীকার করেন না, করতেও পারেন না যে, অদ্যকার এই বাউল সম্রাট তার স্বসময়ে এবং পরবর্তীকালেও অনেকদিন পর্যন্ত বেশরা ন্যাড়ার ফকির বলেই আখ্যায়িত হয়ে এসেছেন। এবং আজ যাকে বলা হচ্ছে মাজার; কিছুদিন মাত্র আগেও তার নাম ছিল লালনের আখড়া; আর ঝোপজঙ্গল পরিকীর্ণ সেই আখড়াটি ছিল গঞ্জিকাসেবী-প্রেমী রসিকজনের নিরিবিলি আশ্রয়স্থল। এই আখড়াই পরিবর্তিত বর্তমান রূপ হলো লালন শাহের মাজার।
সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও অন্য অনেক কারণে ইতোমধ্যে এই মাজার-এর একটি অপরিহার্য প্রভাব বলয়ও তৈরী হয়েছে, যে কারণে দুরদুরান্ত থেকে ডুগি-একতারা ও গাঁজার কল্কি নিয়ে 'সাধক পুরুষেরা' তো আসছেনই, শীরনি-মানতসহ বহু সরল প্রাণ মুসলমানও আসছে এই মাজার জিয়ারত করতে। এটা একটা ফিতনা এবং এমন ফিতনা যার কারণে বহু ঈমান নষ্ট হচ্ছে। বলাই বাহুল্য', লালনের আখড়া কেন্দ্রিক এই ফিতনাটি একেবারে নতুন নয়, তিন সাড়ে তিন দশক আগে এই বিপদের আরম্ভ এবং তারপর থেকে ক্রমাগতই এই ফিতনা প্রবল হয়ে উঠেছে। অথচ সকল সরকার ও সকল সচেতন মানুষের একথা বলা উচিত ছিল-যত বড় আউলিয়াই হোন তার মাজারে গিয়ে কোন কিছু প্রার্থনা করা সুস্পষ্ট র্শিক। অতএব, নিষিদ্ধ; আর এটা তো কোন মাজারই নয়, এটা একজন বাউল গীতিকারের সমাধিত্রে। বিশেষ করে আমাদের আলেম উলামাদের প থেকে এ কথা উচ্চারণ করা খুবই জরুরী ছিল, কারণ এটা তাদের ঈমানী দায়িত্ব। কিন্তু না, তাঁরাও কিছু বলেন না। সম্ভবতঃ বলেন না তার কারণ, তাদের অধিকাংশেরই এমন অবস্থা যে, দোয়ার মাহফিলে ওয়াজ করতে করতেই তারা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন। সামান্য যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট থাকে, তা তারা তসলিমা নাসরিন নামক এক বিপ্তিচিত্ত বালিকা ও কতিপয় মুরতাদ বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে নাটুকে লড়াইয়ের মধ্যেই নিঃশেষ করে ফেলেন। অবশ্য এটি ভিন্ন আলোচনার বস্তু, লালন প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
আমাদের কাছে এটা দুর্বোধ্য যে, লালন যা নয় তা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করতে কিছু মানুষের এত উৎসাহ কেন? আবহমান বাংলা গানের ইতিহাসে লালন যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ, এ নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই; এবং শ্রোতারা তার গানে যদি আনন্দে আন্দোলিত হয় সেখানেও কিছু বলার নেই। কারণ তার সুর ও বাণীর মধ্যে এমন এক ধরণের নান্দনিকতা আছে, যা চিরকালই সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষকে কম-বেশী আকর্ষণ করবেই। কিন্তু এটা তো মনে রাখা উচিত যে, তিনি না কোন দরবেশ এবং তার গান না এতটুকু ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নামাজ রোজা রাসুল ইত্যাদি ধরণের কিছু ইসলামী শব্দ ও দু একটি ইসলামসম্মত পক্তি দেখে কেউ কেউ বিপুলভাবে উৎসাহিত হতে পারেন, কিন্তু বস্তুত তার গানের পুরো আবহই যে ইসলামী আকীদার পরিপন্থী, এ কথা না মানার কোন যুক্তি নেই, কোন উপায়ও নেই। দু একটি মাত্র উদারহণ পেশ করলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় যে, লালন আসলেই কি পরিমাণে ইসলামের সম্পূর্ণ বর্হিভূত এক বেশরা জিন্দিক।
আপনি খোদা আপনি নবী,
আপনি হন আদম সফি
অথবা,
আল্লাহ নবী দুটি অবতার,
গাছ বীজ দেখি যে প্রকার
কিংবা
যে মুরশিদ সেই তো রাসুল, ইহাতে নাই কোন ভূল, খোদাও সে হয়-
এই সকল গান কী প্রমাণ করে? প্রমাণিত হয়, ইসলামের মৌলিক ও অলঙ্ঘ্য দাবি যে তওহিদ, সেই তওহিদের সরাসরি মোকাবিলায় দন্ডায়মান লালন এক কুশলী কবি তীরন্দাজ। তার গান শুনতে যতই মধুরই হোক, তাৎণিক আবেদন হোক যতই মর্মস্পর্শী, আসলে এই গান মুসলমানদের ঈমান ও আকীদা বিধ্বংসী এক একটি দুর্বার মারণাস্ত্র। অথচ কী বদনসীব আমাদের, এমন ঈমানবিনাশী মারণাস্ত্র নির্মাতাকেই আমরা বলছি সুফী দরবেশ আউলিয়া এবং কখনো কখনো বলছি মারেফাতের নিগূঢ় রহস্যভেদী এক ইনসানে-ই-কামেল। কালেমই বটে, না হলে এই কথা কি আর যে কেউ গানে বাধতে পারে-
এক এক দেশের এক এক বাণী,
পাঠান কি সাঁই গুণমনি,
মানুষের রচিত বাণী লালন ফকির কয়।
এমন ইসলাম দরদী কামেল পুরুষ ছাড়া কে আর এমন করে বলতে পারে-
কে বোঝে তোমার অপার লীলে,
তুমি আপনি আল্লাহ ডাকে আল্লাহ বলে।
তুমি আগমেরই ফুল নিগমে রসূল,
এসে আদমের ধড়ে জান হইলে।
কী গর্হিত ও ভয়াবহ উক্তি! রাসূলকে আল্লাহ এবং আল্লাহকে রাসূল মনে করার এই জঘন্যতম আকীদা ইসলামের মূলে কুঠারাঘাত করারই অপচেষ্টা। লালন ফকিরের এই এক ধরণের গান, যেখানে তওহিদ-রেসালাত, কোরআন সুন্নাহ ইসলামের মূল আকীদা বিশ্বাস সবকিছুকে অস্বীকার করে, এক জাতীয় কুহকভরা মরমিয়া নান্দনিকতার মোড়কে এমন সব কথা বলা হয়েছে যা রীতিমত শিরক-কুফর নিফাক ও গোমরাহীর চুড়ান্ত। আফসোস, যা কিছু উৎখাত করবার জন্য এই ধরাপৃষ্ঠে ইসলামের আগমন, লালনের গানে সেই সকল নিষিদ্ধ বিষয়ই বার বার বাঙময় হয়ে উঠে; এবং আরো আফসোস যে, সেই সকল দুর্বাক্যপূর্ণ গান সসম্মান প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।
চলবে..........
লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): লালন, আমাদের মানস, লোক সংস্কৃতি ; ;
http://www.somewhereinblog.net/blog/Natore/29093321
লালন
লালন শাহ বা লালন ফকির (১৭৭৪- অক্টোবর ১৭, ১৮৯০)[১] ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে বাউল সাধক, বাউল গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তাঁকে 'বাউল সম্রাট' হিসেবেও অভিহিত করা হয়। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে 'মহাত্মা' উপাধি দেয়া হয়েছিল।[২]
সূচিপত্র[আড়ালে রাখো] |
[সম্পাদনা]জীবন তথ্য
লালন ফকির অতি জনপ্রিয় বাউল গানের স্রষ্টা হলেও তাঁর জীবন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তিনি একজন বাঙালী যার জন্মস্থান বর্তমানবাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হারিশপুর গ্রামে।[৩] লালন শাহের জাতি বা সম্প্রদায় নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। এই প্রশ্ন তাঁর জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল। পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদি থেকে অনুমিত হয়েছে যে কথিত আছে যে, তিনি হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু ছেলেবেলায় অসুস্থ অবস্থায় তাঁর পরিবার তাঁকে ত্যাগ করে। তখন সিরাজ সাঁই নামের একজন মুসলমান বাউল তাঁকে আশ্রয় দেন এবং সুস্থ করে তোলেন।
লালন কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন। ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। আজও সারা দেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালন শাহের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরীতে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে "মহাত্মা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম রাইচরণ।[৪]
[সম্পাদনা]লালন দর্শন
লালনের বেশ কিছু রচনাবলী থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে আদৌ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেধ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এসবের কোনও মূল্য ছিল না। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। একটি গানে তিনি বলেছেনঃ
" | সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। | " |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনঃ লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন - আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। আরেকটি গানে লালন বলেছেন উক্তি|সব লোকে কয়, লালন ফকির হিন্দু কি যবন।
লালন বলে, আমার আমি না জানি সন্ধান।
[সম্পাদনা]গানের সংগ্রহ
লালন ফকিরের গান "লালন গীতি" বা কখনও "লালন সংগীত" হিসেবে প্রসিদ্ধ। বাউলদের জন্য তিনি যেসব গান রচনা করেন, তা কালে-কালে এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে মানুষ এর মুখে মুখে তা পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর প্রায় সহস্রাধিক গান সংগৃহীত হয়েছে।[৫] | মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন একাই তিন শতাধিক লালন গীতি সংগ্রহ করেছেন যা তাঁর হারামণি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর অন্য দুটি গ্রন্থের শিরোনাম যথাক্রমে 'লালন ফকিরের গান' এবং 'লালন গীতিকা' যাতে বহু কেবল লালন গীতি সংকলিত হয়েছে।
" | মন আমার কি ছার গৌরব করছো ভবে! দেখ না রে সব হাওয়ার খেলা, | " |
প্রেমদাস বৈরাগী গীত এ লালন গীতি সংগ্রহ করেছিলেন মুহাম্মাদ মনসুরউদ্দীন এবং তা মাসিক প্রবাসী পত্রিকার হারামণি অংশে প্রকাশিত হয়েছিল।
[সম্পাদনা]লালনের মাজার
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
- ↑ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, "বাংলার বাউল ও বাউল গান", ৩য় খন্ড, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৮।
- ↑ লালন শাহ-ই প্রথম মহাত্মা উপাধি পান উপমহাদেশে
- ↑ দুদ্দু শাহ, "লালন-জীবনী (পান্ডুলিপি)",পৃষ্ঠা ১।
- ↑ লালন শাহ-ই প্রথম মহাত্মা উপাধি পান উপমহাদেশে
- ↑ এস. এম. লুৎফর রহমান, "লালন শাহ্ জীবন ও গান", ৩য় সংস্করণ, জুন ২০০৬, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২১, ISBN 9845550436।
[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ
- Lalon Fakir: Saint Lalon by Machizo Documentary on Lalon's Life and Philosophy. (UnnayanTV)
- Lyric of pabe samanye ki tar dekha in Manipuri translated by Konthoujam Suranjit
- After Lalon video of a reading done by Allen Ginsberg
- [১] Farhad mazhar on Fakir Lalon Shah
লালন শাহ বা লালন ফকির
লালন শাহ বা লালন ফকির (১৭৭৪-অক্টোবর ১৭, ১৮৯০)ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে বাউল সাধক, বাউল গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তাঁকে 'বাউল সম্রাট' হিসেবেও অভিহিত করা হয়। বাউল ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে 'মহাত্মা' উপাধি দেয়া হয়েছিল।
লালন ফকির অতি জনপ্রিয় বাউল গানের স্রষ্টা হলেও তাঁর জীবন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তিনি একজনবাঙ্গাল যার জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার মহকুমার হারিশপুর গ্রামে। লালন শাহের জাতি বা সম্প্রদায় নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। এই প্রশ্ন তাঁর জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল। পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদি থেকে অনুমিত হয়েছে যে কথিত আছে যে, তিনি হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু ছেলেবেলায় অসুস্থ অবস্থায় তাঁর পরিবার তাঁকে ত্যাগ করে। তখন সিরাজ সাঁই নামের একজন মুসলমান বাউল তাঁকে আশ্রয় দেন এবং সুস্থ করে তোলেন।
লালন কষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন। ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। আজও সারা দেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালন শাহের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরীতে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে "মহাত্মা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম রাইচরণ।
লালনের বেশ কিছু রচনাবলী থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে আদৌ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেধ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এসবের কোনও মূল্য ছিল না। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। একটি গানে তিনি বলেছেনঃ
সব লোকে কয়
লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না তা-নজরে।।
আমি অপার হয়ে বসে আছি ----- (লালন ফকির)
১০ ই মার্চ, ২০০৮ ভোর ৪:৫৪
আমি অপার হয়ে বসে আছি
ওহে দয়াময়
পাড়ে লয়ে যাও আমায়
আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানূ সে বসিলো পাটে
আমি তোমা বিনে
ঘোর সংকটে
না দেখি উপায়
পাড়ে লয়ে যাও আমায়
নাই আমার ভজন সাধন
চিরদিন কু-পথে গমন
আমি নাম শুনেছি পতিত পবন
তাইতে দেই দোহাই
পাড়ে লয়ে যাও আমায়
অগতির না দিলে গতি
ঐ নামে রবে অখ্যাতি
ফকির লালন কয়
ও কূলের পতি
কে বলবে তোমায়
পাড়ে লয়ে যাও আমায়
----------------------- লালন ফকির
আমি অপার হয়ে বসে আছি
**গানটা ব্লগার আবদুর রাজ্জাক শিপন এর জন্য দেয়া হইলো
প্রকাশ করা হয়েছে: লিরিক বিভাগে । সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০০৯
http://www.somewhereinblog.net/blog/bishaktomanushblog/28777904
লালন ফকির ও কতিপয় গুরুতর প্রসঙ্গঃ পর্ব-১
০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১০:১২
পূর্ব কথনঃ গত দু বছর আগে জিয়া আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরের সামনে থেকে লালনের ভাস্কর্য ভেঙ্গে বা সরিয়ে ফেলায় এই ব্লগে তুমুল প্রতিবাদ উঠেছিল। অনেকেই লিখেছেন, বেশীরভাগই এর প্রতিবাদ করে। তখন একটা পঠিত লেখার কথা আমার বার বার মনে হচ্ছিল, ছাত্রাবস্থায় একটি কলাম পড়েছিলাম অধুনালুপ্ত পাক্ষিক পালাবদলে। গত কয়েকদিনে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে লেখাগুলো খুঁজে পেলাম। পক্ষে বিপক্ষে হয়তো অনেক কথাই থাকবে এই লেখার। আমি সম্পূর্ণ নিরাসক্তভাবে এই লেখাটি ব্লগে কয়েকটি পর্বে দিয়ে দেব। মূল লেখকের কোন ঠিকানা আমার জানা নেই। থাকলে তার নিকট থেকে অনুমতি নিতাম। যা হোক, এই লেখাগুলো আপনার চিন্তার খোরাক যোগাবে নিঃসন্দেহে, লালন সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য আপনার পূর্ব ভাবনাকে বদলে দিতে পারে। তাই ধৈর্য্য ধরে কয়েকটি পর্ব পড়তে অনুরোধ করছি।
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতিঃ এই পদ্মা এই মেঘনা, যমুনা সুরমা নদী তটে অথবা তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম সহ শত শত গানের গীতিকার ও সুরকার জনাব আবু জাফর কে অনেকেই চিনেন না। নিভৃতচারী এই ব্যক্তি এক সময় গান নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকতেন। বিশেষ করে লালন সংগীত নিয়ে। তার নিজের লেখা অনেক জনপ্রিয় গান আছে। বাংলা বিভাগে দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। প্রসঙ্গক্রমে বলি, নাটোরের বিখ্যাত লালন সংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীনের স্বামী এই আবু জাফর লেখাপড়া করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁর লেখা তুলে ধরলামঃ
পর্বঃ ১
শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই কবিতা লেখার কাজটিকে প্রীতির চোখেই দেখা হয়। যদিও এই দেখার মধ্যে সর্বদা যে প্রীতিই প্রতিভাত হয় তা নয়, অবজ্ঞা, করুণা ও কৌতুকও মিশ্রিত থাকে। অর্থাৎ কবিরা নিজে যাই ভাবুন, বিদগ্ধ সাহিত্যপ্রেমীরা যাই বলুন- এটা সত্য যে, কবিদের সামাজিক মূল্য বিশেষ আশাপ্রদ নয়, উল্লেখযোগ্যও নয়। নোবেল পুরস্কার পেয়ে কেউ কেই আকস্মিকভাবে ধনাঢ্য ও জগদ্বিখ্যাত হয়ে যান বটে, কিন্তু সে নিতান্তই ব্যতিক্রম। অধিকাংশ কবিই আমৃত্যু এক ধরণের অবহেলার মধ্যেই জীবন যাপন করেন। অবশ্য একালের কবিরা যেহেতু একটু চতুর প্রকৃতির, তাঁরা কবিতার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকেও যথোচিত মনোনিবেশ করেন। তাঁরা যুগপৎ শিক্ষিত, সংস্কৃতিসেবী-ব্যবসায়ী এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চর্তুদিকে সততই এমন অনুগত লাটিমের মত ঘূর্ণায়মান যে, তারাও বহু সভায় সভাপতি বা প্রধান অতিথির আসন প্রায়শ অলংকৃত করেন। কিন্তু সবাই জানে, তাঁরা নিজেরাও জানেন, এই সম্মান ও প্রতিষ্ঠার মূলধন কবিতা নয়, চাটুকারিতা ও ক্ষমতাবানদের সম্মুখে নতজানু হয়ে নিজেকে এক সহজ দ্রবণে পরিনত করার অসামান্য দক্ষতা এবং যে কবি যত চাতুর্যের সঙ্গে এই দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন, তিনি তত বড় কবি। কবিরা এ কথায় উষ্মা প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু কথা সত্য।
অবশ্য চিরকাল এমন ছিল না। বিদূষক ধরণের রাজকবি চিরকালই ছিল, কিন্তু তার বাইরের কবিতার প্রতি সৎ ও বিশ্বস্ত এমন অনেক কবিও ছিলেন যারা কারো মন রক্ষার কথা না ভেবে এক সঙ্গে নিজস্ব আবেগে ও অনুরাগে ফুলে ফুলে উঠতেন। এরকমই একজন আত্নমগ্ন, সামাজিক স্বীকৃতির প্রতি সর্বাংশে ভ্রুক্ষেপহীন, একান্ত আবেগে আন্দোলিত একজন লোককবির নাম লালন ফকির। কেউ কেউ বলেন 'সাঁইজী'। তবে 'সাঁই' বা 'ফকির' যাই হোক, লালন যে বাউল পদরচনায় অমিত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, এবং তাঁর গানের আকর্ষণ যে খুবই দুর্বার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবং সুর ও বাণীর সমন্বয়ে লালন যে অসংখ্য শিল্পসুষমামন্ডিত, নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ হৃদয়দ্রাবী গান উপহার দিয়েছেন, সেই উপহার বাংলাভাষী জনগণের একটি চিরায়ত সম্পদ।
কিন্তু লালনকে নিয়ে অন্য সমস্যা আছে; এবং সমস্যা একটি নয়, একাধিক। এখনো যে একটি বিষয়ের মিমাংসা হলো না, তাহলো লোকটি জন্মসূত্রে কী ছিলেন, হিন্দু না মুসলমান? নানা রকম তর্ক বির্তকের পর এখন অবশ্য মুসলমান বলেই মনে করা হচ্ছে। যারা তাকে হিন্দু বলে বিশ্বাস করেন, কান্তি ও অনীহাবশত তারা এখন অনেকটাই নীরব। লালন যে সকল গবেষকের কাছে মুসলমান তারা লালনের জন্মস্থান হরিশপুরসহ পিতামাতা, আত্নীয়-পরিজনের পরিচয়ও নির্ভূলভাবে চিহ্নিত করেছেন। লালন নিজে অবশ্য নিজের সম্পর্কে কিছুই বলেন নি, এমনকি ভুলক্রমে গানের কোথায়ও কোনরূপ পরিচিতি প্রকাশ হয়ে পড়ে এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন।
অর্থাৎ খুব সচেতনভাবেই লালন তার ধর্ম ও জন্মগত পরিচয় গোপন করেছিলেন। গবেষকদের চিন্তাভাবনার পরিসরও বড়, রহস্যভেদী দুরদর্শিতাও অপরিসীম। তাদের কারও সাথেই কোন তর্কে প্রবৃত্ত হবার ইচ্ছে নেই, শক্তিও নেই। অতিশয় ক্ষীণকন্ঠে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই, প্রাণদন্ডে দন্ডিত কোন খুনী বা বড় ধরণের কোন দস্যু-তস্কর ছাড়া কোন মুসলমান কি কখনো আত্নগোপন করে? তার তো জাতি ধর্ম নিয়ে কোন ভয় নেই, হীনমন্যতাও নেই, বিনা কারণে সে কেন জন্ম ও ধর্ম পরিচয়কে সর্বদা আড়াল করে রাখবে? সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে এই ধরণের গান লেখার জন্য রহস্যময় আবরণ সৃষ্টি করার কোন প্রয়োজন হয় না; সব ধর্মকেই অস্বীকার করাই যথেষ্ট অথবা সব ধর্মকেই আপন ভেবে সর্বপ্রেমী ধর্ম নিরপেক্ষ হলেই যথেষ্ট। আসলে লালনের এই ধরণের আত্নগোপন ইচ্ছেকৃত নয়, বাধ্যতামূলক।
ডঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কথাই সর্বাংশে সঠিক, লালন ছিলেন জন্মসূত্রে একজন কায়স্থ হিন্দু এবং তার জন্মস্থান ছিল কুমারখালীর অপর পারে গড়াই নদী তীরবর্তী ভাঁড়ারা গ্রামে। বর্তমান নিবন্ধকারের যুক্তি, লালনের সমসাময়িক হিন্দু সমাজ ছিল অত্যন্ত কঠোর। ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক লালন মুসলমান পরিবারে অবস্থানসহ 'অন্নজল' গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভাঁড়ারায় ফিরে গিয়ে তিনি দেখলেন, তিনি কঠিনভাবে সমাজচ্যুত। হয়ত প্রায়শ্চিত্তের কোন ব্যবস্থা ছিল কিন্তু স্ব সমাজের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা ও ক্ষোভে এবং অভিমান নিয়ে লালন ফিরে এলেন দেঁউড়িয়ায় তার মুসলমান আশ্রয়দাত্রীর কাছে। সমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করলো। তিনিও রক্ত-ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পরিণত হলেন এক নবজাত-লালনে। যৌক্তিক দিক থেকে জন্ম পরিচয়হীন এই ধরণের আত্নগোপনতাই স্বাভাবিক বলে ধারণা করা হয।
আর তিনি যদি মুসলমান হতেন এবং তার জন্মস্থান হতো হরিশপুর, তিনি চাইলেও তার পরিচয় তিনি আড়াল করে রাখতে পারতেন না। তিনি জীবদ্দশায়ই বিখ্যাত; এবং তার দেউরিয়াস্থ আখড়া থেকে হরিশপুরের দুরত্ব এমন বেশী নয়। হরিশপুর থেকে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বলতো-এ লালন আমাদেরই সন্তান। কিন্তু না, তার দীর্ঘ জীবনে এমন কথা কেউ কখনো বলে নি। অতএব দু'একজন উপাধি লিপ্সু গবেষক যত যাই বলুন, যত দলিল প্রমাণই উপস্থাপন করুন, বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর যে, লালনের বাড়ি ছিল হরিশপুর এবং তিনি মুসলিম সন্তান। যে এক কলমিপুঁথির অবলম্বণে লালনকে মুসলমান বানানো হয়েছে, খুবই রহস্যময় ও কৌতুককর যে সেই পুঁথিটিও কোন এক সর্বনাশা অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত হয়ে গেছে; এখন একটি নকল পুঁথিই সম্বল। কিন্তু আসলটা যখন অক্ষত ছিল তখন আরেকটি নকল লেখনের কী প্রয়োজন ছিল? তারপর মূলকপিটি যখন পুড়েই গেল, হুবহু দ্বিতীয় একটি কপি তৈরী হলো কি করে? পুরো ব্যাপারটাই কোন মতলবী-নাটক নয় তো? বিশেষ করে পুঁথি বিশেষজ্ঞরা যখন ভাষা শব্দ ও অন্যান্য বিচারে উপস্থাপিত এই নকল কপিটিকে ঘোরতরভাবে সন্দেহ করেন, তখন আমাদের মত মুর্খজনেরা ভাবতে বাধ্য হয় যে, আমাদের কতিপয় উপাধিলোভী গবেষক গবেষণার চেয়ে নাটক রচনাতেই বেশী পারঙ্গম।
বলা আবশ্যক, আমার নিজের নানা কারণে আমার মধ্যে লালনের প্রতি কিছু অনুরাগ জন্মেছিল, সেই সূত্রে তার জীবন ও শিল্পকর্ম সম্পর্কে কিছু চিন্তা-ভাবনাও করেছিলাম। আমার মনে হয়েছে, আমাদের মধ্যে একজন মাত্র আছেন যিনি লালন গবেষণায় নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, তিনি ডঃ আবুল আহসান চৌধুরী। তাছাড়া অধিকাংশই পূর্ব ধারণা ও মতলবী-উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত। তবে সুখের বিষয় আলোচ্য সমস্যাটি একটি অতিশয় লঘু সমস্যা। এ নিয়ে কেউ কেউ জীবনপাত পরিশ্রম করলেও করতে পারেন কিন্তু এতে মেধা ও মনীষার কোন হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। লালন হিন্দু ছিলেন না মুসলমান ছিলেন, এ বিষয়ে সাধারণ জনমনে যদিও কিছুটা কৌতুহল আছে, কিন্তু এই অনাবশ্যক লঘু-কৌতুহল আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়; এবং এতে বিশেষ কিছু এসেও যায় না।
চলবে...........
লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): লালন, আমাদের মানস, লোক সংস্কৃতি ;
http://www.somewhereinblog.net/blog/Natore/29092717
লালন নিয়ে আরো ছবি
তানভীর মোকাম্মেলের ছবিতে লালন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। 'মনের মানুষ' ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন সিরাজ সাঁই চরিত্রে। তিনি হাসান ইমামের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে জানান, 'তানভীর মোকাম্মেলের ছবিটি হয়েছিল লালনের জীবনী নিয়ে। আর গৌতম ঘোষের ছবিটি তৈরি হয়েছে লালনের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে। গৌতম ঘোষ বরাবরই ভালো মানের ছবি বানান। এ ছবিটিও নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম হবে না।http://www.dailykalerkantho.com/~dailykal/?view=details&feature=yes&type=gold&data=Economics&pub_no=357&cat_id=1&menu_id=78&news_type_id=1&index=1&archiev=yes&arch_date=02-12-2010
বাউল ও লালন
আ বু ই স হা ক হো সে ন
লালন শাহের নাম নিলেই অপরিহার্যভাবে বাউল শব্দটা আমাদের সামনে এসে যায়। লালন এবং বাউলকে তাই অনেকেই সমার্থক হিসেবে দেখে। আর এই সচেতন ভুলের জন্য লালন আমাদের কাছে খণ্ডিত, বঞ্চিত এবং সমাজের মূলস্রোত হতে বিচ্ছিন্ন। তাই লালনের জীবদ্দশায় তাঁকে সামনে রেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা একমাত্র পোর্ট্রটেটি পক্ষপাতদূষ্টের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তার স্খলে লালন শাহের মৃত্যুর ২৬ বছর পর ১৯১৬ সালে নন্দলাল বসুর আঁকা কাল্পনিক ছবি লালনের আসল প্রতিকৃতি হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃত। এ যেন 'রাখ তোর দেখা কথা আমি নিজ কানে শুনে এসেছি'। এভাবেই সমাজ সচেতন, বিশিষ্ট দার্শনিক, সংসারী ব্যক্তি লালন হয়ে গেছেন ক্ষ্যাপা উন্মাদ বাউল। আর এই বাউল বাউল বলেই সাঁইজিকে আলগোছে একপাশে সরিয়ে রেখে জাতে উঠতে না দেবার প্রয়াসও বাড়াবাড়িভাবে লক্ষণীয়। এজন্য লালন শাহ কবি হয়েও বাউল কবি, দার্শনিক হয়েও মরমি দার্শনিক, ধর্ম প্রচারক হয়েও গুহ্য সাধক, সমাজ সংস্কারক হয়েও ক্ষ্যাপা বাউল। কিন্তু লালনের দর্শন, জীবনাচার, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা সকল মহলের ভ্রান্তিকে পেছনে ফেলে সাঁইজিকে দিন দিন আরো উজ্জ্বল করে সবার সামনে নতুন পরিচয়ে নতুনভাবে উপস্খাপন করছে। যতদিন সাঁইজির দর্শন থাকবে ততদিন তিনি ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে অনিবার্যভাবে সবার সামনে এসে দাঁড়াবেন। এটাই ইতিহাসের প্রতিশ্রুতি। লালন শাহ কতটুকু বাউল ছিলেন এবং আসলেই তিনি বাউল ছিলেন কিনা তা এখন খতিয়ে দেখার দিন এসেছে। আর সেই বোধ থেকেই আমরা সাঁইজির পরিচয় অনুসান করবো। তাই প্রথমেই বাউল শব্দের উদ্ভব, বাউল সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং তাদের জীবনাচার নিয়ে সংক্ষেপে দু'চার কথা বলে নেয়া দরকারী।
ব্যবহারগত দিক দিয়ে বাউল শব্দটির ইতিহাস খুব প্রাচীন নয় বলে গবেষকদের অধিকাংশের মত। তাদের মতে বাংলা সাহিত্যে বাউল শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ করি মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষä বিজয়' কাব্যের মাধ্যমে। মালাধর বসু তাঁর কাব্যে উপমা হিসেবে বাউল শব্দটি এভাবে ব্যবহার করেছেন,
'মুকুল (৩) মাথার চুল/নাংটা যেন বাউল/রাক্ষসে রাক্ষসে বুলে রণে।'
বাউল শব্দটির ব্যবহার আরো ব্যাপক অর্থে আমরা লক্ষ করি 'চৈতন্য চরিতামৃত' কাব্যে। সেখানে বাউলের ছবি আঁকতে গিয়ে বাউলকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে,
'বাউলকে কহিও লোক হইল আউল/বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল €/বাউলকে কহি কাযে নাহিক আউল/বাউলকে কহিও ইহা করিয়াছে বাউল €'
মোটামুটিভাবে বলা যায় পঞ্চদশ শতকে বাউল শব্দটা আমাদের গোচরে আসে। বাউলরা তাদের আদিপুরুষ হিসেবে বীরভদ্রকে মানে যার জীবনকাল ছিল (১৪৭৩-১৫৪৪)। এ প্রসঙ্গে ডক্টর এম.এ. রহিম তার বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস গ্রন্থে বলেন, 'বাউলগণ নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রকে তাদের প্রথম গুরুরূপে অভিহিত করে এবং বিশ্বাস করে যে, তিনি মাধব বিবি নামক জনৈক মুসলমান রমণীর কাছ থেকে বাউল ধর্মমত শিক্ষা করেন' (রহিম; পৃ:-৪০৪)।
এসব তথ্যের উপর নির্ভর করে বলা যায় যে আমাদের সামনে যে বাউল বা বাউল শব্দ দিয়ে যা বোঝায় তার আবির্ভাব পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যে।
বাউলমতের উদ্ভব নিয়ে যেমন চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যায় না তেমনি বাউল শব্দটির উদ্ভব নিয়ে রয়েছে নানা মুণির নানা মত। কোন কোন গবেষকের মতে সংস্কৃত 'ব্যাকুল' বা 'বাতুল' শব্দ হতে বাউল শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ হলো উন্মাদ, পাগল। আবার কারো কারো মত হিন্দি 'বাউর' শব্দ থেকে বাউল শব্দটি বাংলায় এসেছে যার অর্থ হলো পাগল। ড. এস এম লুৎফর রহমান বাউল শব্দের উদ্ভবের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে তিনি চর্যাগীতি ও অবহ্টঠ রচনার কথা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে বাউল শব্দটি একটা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান আকারে এসেছে। তিনি মনে করেন বাজির, বাজ্জিল, বাজুল এগুলি বাউল শব্দের আদিরূপ। তার মতে বাউল শব্দটির বিবর্তনের ক্রমপর্যায় এমন-বাজ্রী-বাজ্জির-বাজির-বাজ্জিল-বাজিল-বাজুল-বাউল। বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে শব্দটির রূপ ভিন্ন হলেও এর অর্থের কোন হেরফের হয়নি। এক্ষেত্রেও বাউল বলতে ভাবের উন্মাদ বা পাগলকেই বোঝানো হত। কিছু কিছু পণ্ডিতের মতে বাউল শব্দটি উৎপত্তিগতভাবে বাংলা। অর্থাৎ বাংলা থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি। এ প্রসঙ্গে মুহম্মদ এনামুল তার 'অ ঐরং:ড়ৎু ড়ভ ঝঁভরংস রহ ইবহমধষÿ গ্রন্থে বলেন, 'অপপড়ৎফরহম :ড় ংড়সব ংপযড়ষধৎং, :যব ড়িৎফ ইড়ঁষ রং :যব ইবহমধষর ফবারধ:রড়হ ড়ভ চৎধশর: ডড়ৎফ ইড়ঁষ সবধহরহম ফরংড়ৎফবৎবফ, রহপড়হংরং:বহ:, ধহফ যবহপব সধফ. (হক, পৃ:-২৯৬).
ড. আনোয়ারুল করীম-এর মতানুসারে বাউল শব্দের উৎসভূমি পারস্য। তিনি বলেছেন, 'মরুভূমিতে এখানে সেখানে বিচরণকারী সংসারত্যাগী একশ্রেণীর সঙ্গীতাশ্রয়ী সুফী সাধক বা 'আল' অথবা 'বউল' নামে পরিচিত ছিল। এরা অধ্যাত্মবাদী এবং এদের সাধনপদ্ধতি ছিল গুপ্ত ও যৌনাচারভিত্তিক। আমাদের আলোচ্য বাউল সম্প্রদায় পারস্যের এই 'আল' বা 'বউল' সম্পদায়ের উত্তরসূরি' (করীম, পৃ:-৩০)। তিনি বাউল শব্দের বাংলায় প্রথম ব্যবহার বিষয়েও ভিন্ন মত পোষণ করে বলেছেন, 'চর্তুদশ শতকে শাহ মুহাম্মদ সগীরের 'ইউসুফ জোলেখা' গ্রন্থে সর্ব প্রথম এই ধর্মীয় সাধকদের 'বাউল' এবং 'বাউর' নামে চিহ্নিত করা হয়েছে' (প্রাগুপ্ত)।
বাউল শব্দের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস যা-ই হোক সর্বক্ষেত্রেই এটা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। অর্থাৎ বাউল বলতে এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টিকে বোঝায় সমাজের চোখে যারা অত্যন্ত নীচ, নি:স্ব এবং পাগল। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, বিষয় সম্পত্তি বা সামাজিক প্রতিপত্তি বলতে কোন কিছুই নেই। তাদের কোন স্খায়ী বসতবাড়ি নেই। তারা একস্খান হতে অন্য স্খানে ঘুরে বেড়ায় এবং পরান্নে জীবন ধারণ করে বেঁচে থাকে। বাউল সে যে সমাজেরই হোক তার বৈশিষ্ট্য, জীবনযাপন প্রণালী, সমাজে তার সামাজিক অবস্খান একই। ড. আনোয়ারুল করীম তার 'রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বাউল' গ্রন্থে বলেন,'একশ্রেণির সাধক যারা 'ফকির' বলে পরিচিত এবং পেশায় ভিক্ষজীবী, সাধনসঙ্গিনী নিয়ে এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে গান গেয়ে ফেরে, সমাজে যাদের পরিচয় অতি সাধারণ, অর্থাৎ যারা অন্ত্যজ, তাদেরকে বাউল বলা হয়ে থাকে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য বাউল সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেখানে তারা সামাজিকভাবে নিন্দিত'(করীম; পৃ:-২৯)।
বাউল সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং বিস্তারের সর্বশেষ পর্যায়ের পর্যালোচনায় দেখা যায় বাংলাদেশে সংসারত্যাগী বাউলের পাশাপাশি গৃহী বাউলেরও উদ্ভব হয়েছে। তবে তাদেরও সামাজিক অবস্খান ও মর্যাদা সমাজে খুবই হীন। গৃহী বাউলদেরকে সমাজ অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে। সমাজের অভিযোগ তারা সমাজের মধ্যে বাস করে নানা ধরনের অনাচার, অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত। সাধুসেবা নামে স্বেচ্ছাচার, নারী পুরুষের নির্বিচার মেলামেশা যা প্রমিউসকিউটির পর্যায়ে পড়ে ইত্যাদি অসমাজিক কার্যকলাপে অভ্যস্ত গৃহী বাউলরা প্রকৃতপক্ষেই সমাজের দুষ্টগ্রহ। তাই সমাজ কখনোই তাদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। তাই সমাজের ভিতর থেকেও তারা অনেকটা সমাজবর্হিভূত। তাই দেখা যায় বাউল সে গৃহী বাউল হোক আর গৃহত্যাগী বাউলই হোক সমাজের তাদের অবস্খান একেবারেই নিম্নস্তরে।
এখন আমরা লালন সাঁইজির ব্যক্তিজীবন, সামাজিক অবস্খান, সামাজিক প্রতিপত্তি এবং সমাজে তাঁর ব্যক্তি প্রভাব নিয়ে আলোচনার নিরিখে বাউল হিসেবে সাঁইজির অবস্খানটি পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো। লালন সাঁইজিকে প্রথমবারের মতো পাঠকের সামনে আনেন 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' সংবাদপত্রের সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ। ১৮৭২ সালের আগস্ট মাসে তাঁর 'সাপ্তাহিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' পত্রিকায় 'জাতি' নামক এক নিবে লালন সাঁই এবং তাঁর প্রচারিত ধর্মমতের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে এভাবেই উল্লেখ করা হয়, 'লালন শা নামে এক কায়স্খ আর এক ধর্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিশেষ বিবরণ প্রকাশ করিব। ৩/৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে।'(যুক্তবঙ্গে লালন চর্চার ক্রমবিকাশ; সৈয়দ মনসুর আহমদ; পৃ:-৩৩)। কাঙাল হরিনাথের এই বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে লালন সাঁইজি তৎকালীন সমাজের ঘুণেধরা সমাজকাঠামোতে জোর ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তৎকালীন সমাজকাঠামো স্বভাবতই লালনের এই সামাজিক আন্দোলন দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। সামাজিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তৎকালীন সমাজে লালন শাহের একটি অপরিহার্য অবস্খান তৈরি হয়েছিল। লালন প্রভাব তাই ঘুণেধরা সমাজের মৌলবাদী সমাজপতিদের শংকিত করে তুলেছিল। লালন চর্চার ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নিব প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর লালন সাঁইজির দেহত্যাগের ১৪ দিন পর মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক 'হিতকরী' পত্রিকায়। বর্ণিত পাক্ষিক 'হিতকরী' পত্রিকায় পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ও এজেন্ট রাইচরণ দাস (মতান্তরে বিশ্বাস) 'মহাত্মা লালন ফকির' নামে এক নিবে লালন সাঁইজির জীবন ও কর্মের উপর আলোকপাত করেন। উক্ত নিবে নিবকার সাঁইজি সম্পর্কে আমাদের জানান, 'লালন ফকিরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকী নাই। শুধু এ অঞ্চল কেন, পূর্বে চট্রগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্খানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকিরের শিষ্য। …ইঁহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি'। (লোককবি লালন-তপনকুমার বিশ্বাস; পৃ:-১৩৬)। এরপর আর লালন সাঁইজির সামাজিক অবস্খান ও সমাজে তাঁর ব্যক্তিপ্রভাব ও সামাজিক প্রতিপত্তি নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। নিবে সূত্রে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তাঁর ব্যক্তি প্রভাব শুধু তাঁর নিজ সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তা সারা বাংলাদেশব্যাপী বিস্তৃত ছিল। নিবে লালন সাঁইজিকে স্পষ্টতই বাউলদের থেকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, 'সাধুসেবা হইতে লালনের শিষ্যগণের না হউক নিজের মতবিশ্বাস অনেকাংশে ভিন্ন ছিল। সাধুসেবা ও বাউলের দলে যে কলঙ্ক দেখিতে পাই, লালনের সম্প্রদায়ে সে প্রকার কিছু নাই' (প্রাগুপ্ত)। শ্রী সনৎকুমার মিত্র সম্পাদিত 'বাউল লালন রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে 'গ্রাম্য সাহিত্য প্রবে সুবোধচ্দ্র মজুমদার লালন সাঁইজির ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক জীবনের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, 'ফকির লালনের ধর্মজীবন বিলক্ষণ উন্নত ছিল। মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকির বড়ই ঘৃণা করিতেন' (মিত্র; পৃ:-১০১)। লালন শাহের গানেও মিথ্যা ও জুয়াচুরি এবং পর রমণীর প্রতি লোভকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে। লালন বলেন, 'সত্য বল, সুপথে চল ওরে আমার মন/সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন €
পরের দ্রব্য পরের নারী/হরণ করো না পারে যেতে পারবানা/যতবার করিবে হরণ/ততবারই হবে জনম €'
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে চরিত্রগত দিক দিয়ে লালন সাঁইজির জীবনাচারের সাথে বাউল সম্প্রদায়ের জীবনাচারের কোন মিল নেই। কোন কোন গবেষক বাউলদের সংসারত্যাগী ও গৃহী বাউল এই ভাগে বাউলদের ভাগ করে গৃহী বাউল হতে সংসারত্যাগী বাউলদের আলাদা করে দেখিয়ে বাউলদের জাত বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। কারণ গৃহী বাউল অতি মাত্রায় সামাজিক অনাচারে লিপ্ত। অনেকে আবার এ জন্য গৃহী বাউলদের বাউল বলতেও নারাজ। মুহম্মদ এনামুল হক বলেন, 'টফধংরহ ইড়ঁষং ধৎব ৎবধষষু সুং:রপ; :যবু সড়ং:ষু ফরভভবৎ রহ ঢ়ৎধপ:রপবং ধহফ সধহহবৎং রি:য :যবরৎ ভবষষড়ি এৎরযর ইড়ঁষং, সধহু ড়ভ যিড়স ধৎব মবহবৎধষষু রহপধৎহধ:রড়হ ড়ভ পড়ৎৎঁঢ়:রড়হ, ারপব, ধহফ সড়ৎনরফ ংবীঁধষর:ু. ঐবহপবভড়ৎধিৎফ, যিবহ বি ংযধষষ ংঢ়বধশ ড়ভ ইড়ঁষ, বি ফড় হড়: সবধহ এৎরযর ধহফ পড়ৎৎঁঢ়: ইড়ঁষÿ (হক, পৃ:-৩০১)।
সুতরাং বাউল বলতে গবেষকগণ সংসারত্যাগী উদাসীন বাউলদেরকেই বুঝিয়েছেন। তাছাড়া গৃহী বাউলদের জীবনাচারের সাথে লালন শাহের জীবনাচারেরও বিস্তর ফারাক। তাই জোর দিয়ে বলা যায় লালন সাঁইজি কোনক্রমেই গৃহী বাউল ছিলেন না। বাউল শব্দের উদ্ভব ও বিকাশের আলোচনায় বাউল শব্দ দিয়ে যে সংসারত্যাগী উদাসীন ভাবোন্মাদ, ক্ষ্যাপা বাউলকে বোঝানো হয়েছে, সমাজে যাদের সামাজিক অবস্খান, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বিন্দুমাত্র ছিল না; যারা সাধনসঙ্গিনী নিয়ে এক স্খান থেকে আরেক স্খানে ঘুরে বেড়াত ও গান গেয়ে পরান্নে জীবন ধারণ করত তাদের জীবনাচারের সাথেও সাঁইজির জীবনাচার মেলে না। সাঁইজি পুরোদস্তর সংসারী লোক ছিলেন। তাঁর পানের বরজ, আমের বাগান, বসতবাড়ি, নগদ টাকা, চলাচলের বাহন হিসেবে দুটি ঘোড়া এবং স্ত্রী সন্তান (পালক কন্যা) ছিল। যা পুরোপুরি বাউল জীবনের সাথে বেমানান। সমাজে লালন শাহের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি প্রায় মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ছিল। এ প্রসঙ্গে সুবোধচন্দ্র মজুমদার বলেন, 'লালন ফকির নাম শুনিয়াই হয়ত অনেকে মনে করিতে পারেন ইনি বিষয়হীন ফকির ছিলেন; বস্তুত তাহা নহে; ইনি সংসারী ছিলেন, সামান্য জোতজমা আছে; বাটিঘরও মন্দ নহে। জিনিস-পত্র মধ্যবর্তী গৃহস্খের মত, নগদ টাকা প্রায় ২ হাজার রাখিয়া মারা যান' (মিত্র-পৃ:-১০২)। ১৮৯০ সালের দুই হাজার টাকার বর্তমান বাজার মূল্য নিশ্চয় লক্ষাধিক হবে। কোন বাউলের তো নয়ই সাধারণ গ্রাম্য কৃষকের হাতে এত নগদ টাকা থাকাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। লালন শাহ তাঁর জীবদ্দশায় ঘোড়ায় চড়ে একস্খান হতে অন্যস্খানে চলাচল করতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য লালন শাহের সময়ে গ্রামবাংলায় ঘোড়া ও পালকি অভিজাত বাহন হিসেবে গণ্য হতো। লালন শাহের দুটি তেজি ঘোড়া থাকার কথাও সকল গবেষক কর্তৃক স্বীকৃত। গ্রামীণ সমাজের সাধারণ কোন গ্রামবাসীর পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে চলাফেরার বিলাসিতা করার কোন নজির নেই। কোন বাউলের ঘোড়ায় চড়ার নজির তো নেই-ই। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লালন গবেষক মো: সোলায়মান আলী সরকার তাঁর 'লালন শাহের মরমী দর্শন' গ্রন্থে বলেন, 'যিনি ঘোড়ায় চড়ে দেশ-বিদেশে ধর্ম-প্রচার করেন, তিনি বাউল নন। বাউলরা একতারা হাতে পায়ে-হেঁটে গান গেয়ে বেড়ান। দীর্ঘকাল অনুসান করে কোন বাউলকে ঘোড়ায় চড়ে ধর্ম-প্রচার করতে দেখা যায়নি।' (সরকার; পৃ:-৫)।
লালন সাঁইজি ১৮৯০ সালে যখন দেহত্যাগ করেন তখন তিনি প্রায় দুই হাজার নগদ টাকা রেখে যান। তিনি তাঁর পালক পিতা মওলানা মলম শাহ-সূত্রে পাঁচ একর বসতবাড়ির ভিটা লাভ করে যেখানে লালন শাহ তাঁর আখড়াবাড়ি স্খাপন করেন এবং বর্তমানে যেখানে তাঁর মাজার অবস্খিত। এ ছাড়াও তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পাঁচবিঘা জমি কিনেছিলেন। ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে শৈলকুপা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে লালন শাহের অনুকূলে দুটি দলিল সম্পাদিত হয়। যাতে তাঁকে 'মান্যবান ও সম্ভ্রান্ত মনুষ্য' বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশিষ্ট লালন গবেষক মুহম্মদ আবু তালিব-এর নিকট দলিল দুটির নকল কপি রক্ষিত আছে। তাঁর ঘরবাড়ির অবস্খাও গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ছিল। লালন শাহ সমাজে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সমাজের অনেক গণ্যমান্য ও পণ্ডিত ব্যক্তির সাথে তাঁর সদ্ভাব ছিল এবং তারা লালন শাহের সাথে মতবিনিময় করে নিজেদেরকে উৎকর্ষিত করে তুলেছেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন ভারতের ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা ও বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি তার জমিদারিতে লালন সাঁইজিকে ডেকে নিয়ে ধর্মালাপে তৃপ্ত হতেন। এ প্রসঙ্গে মো: সোলাইমান আলী সরকার তার 'লালন শাহের মরমী দর্শন' বইতে উল্লেখ করেছেন, 'বঙ্গের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এমনকি ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা, সমাজ সংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁকে নিমন্ত্রণ করে শিলাইদহে নৌকায় নিয়ে ধর্মালাপে পরিতৃপ্ত হন' (সরকার; পৃ:-৬)। আর এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই লালন সাঁইজির সাথে ঠাকুর পরিবারের এক অনিবার্য ঘনিষ্ঠতা লক্ষ করা যায়। যার ফল স্বরূপ লালন শাহ কখনো কখনো ঠাকুর পরিবারের বিশেষ আনুকল্য লাভ করতেন। যেমন সাঁইজির দরিদ্র ভক্তকুলকে সাঁইজির খাতিরে অনেক সময় জমিদারী খাজনা মওকুফ করা হতো। তাছাড়া ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা দেখব যে, সাঁইজির এই ব্যক্তি প্রভাব শুধু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় পর্যন্তই ছিল না। তা তার পরবর্তী জেনারেশন পর্যন্ত গড়িয়েছে। ঠাকুর পরিবারের যারাই সাঁইজির সংস্পর্শে এসেছেন বা সাঁইজির দর্শনের সংস্পর্শে এসেছেন তারাই সাঁইজির প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত হয়েছে পড়েছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় ঠাকুর পরিবারের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাংলা ভাষা তথা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন বিশ্বকবি রবীন্দ্রাথের মাধ্যমে লালন শাহ সুধী সমাজের তথা নাগরিক সমাজের গোচরে আসেন এবং বিশ্বব্যাপী লালন শাহের পরিচিতির প্লাটফর্ম তৈরি হয়। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন পরবর্তীতে তাঁর অনুজ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা সরলা দেবী প্রমুখের মাধ্যমে লালন চর্চার ক্ষেত্র অবারিত হতে থাকে। এলাকার প্রভাবশালী জমিদার পরিবারের সাথে যাঁর ঘনিষ্ঠতা তাঁর সামাজিক অবস্খা যৌক্তিক কারণেই ভাল হবার কথা এবং সমাজে তাঁর একটা প্রভাব থাকার কথা। নিদেনপক্ষে সমাজের চোখে তিনি অন্ত্যুজ, বাতুল এবং ক্ষ্যাপা হিসেবে পরিগণিত হবার কথা নয়। সুতরাং বাউল শব্দের শাব্দিক অর্থে এবং সামাজিকভাবে বাউল বলতে আমরা যা বুঝি অবশ্যই লালন শাহ সেই অর্থে বাউল ছিলেন না।
এ বিষয়টিকে আরো ভালভাবে বোঝার জন্য লালন শাহ সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষকগণের মন্তব্যকে সহায়ক নির্ঘন্ট হিসেবে আমরা উল্লেক করতে পারি। তপনকুমার বিশ্বাস তার লোককবি লালন গ্রন্থে লালন শাহকে কবি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথের মতো লালন শাহও কবি ভাবকবি, লোককবি। রবীন্দ্রনাথ লালনকে শুধু কবি বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি লালনের কবিতাকে (গান) বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলি'র কবিতার সমতুল্য বলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি লালনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে উপনিষদের ঋষিদের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ''ঞযব ারষষধমব ঢ়ড়ব: বারফবহ:ষু ধমৎববং রি:য ড়ঁৎ ংধমব ড়ভ টঢ়ধহবংযধফ যিড় ংধুং :যধ: ড়ঁৎ সরহফ পড়সবং নধপশ নধভভষবফ রহ র:ং ধ::বসঢ়: :ড় ৎবধপয :যব ঁহশহড়হি ইবরহম; ধহফ ুব: :যরং ঢ়ড়ব: ষরশব :যব ধহপরবহ: ংধমব ফড়বং হড়: মরাব ঁঢ় ধফাবহ:ঁৎব ড়ভ :যব রহভরহর:ব :যঁং রসঢ়ষুরহম :যধ: :যবৎব রং ধ ধিু :ড় র:ং ৎবধষরংধ:রড়হ.ÿ(লোককবি লালন-তপনকুমুার বিশ্বাস; পৃ:-৪৮)।
বিশিষ্ট লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী লালন শাহকে সমাজমনস্ক সাধক কবি বলে অভিহিত করেছেন। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লালন শাহকে ভক্ত-কবি বলে অভিহিত করেছেন বাউল হিসেবে নয়। বিশিষ্ট লালন গবেষক মো: সোলায়মান আলী সরকার লালন শাহকে মরমী দার্শনিক হিসেবে দেখেছেন। তিনি লালন সাঁইজির দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন যে, লালনের দর্শন বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত দার্শনিক যেমন সক্রেটিস, ইবনুল আরাবী, রুমি, হাফিজ প্রমুখের দর্শনের সাথে তুল্য। মৌলভী আব্দুল ওয়ালী তার 'ঙহ ঈঁৎরড়ঁং ঞবহব:ং ধহফ ঢ়ৎধপ:রপবং ড়ভ ঈবৎ:ধরহ পষধংং ড়ভ ঋধশরৎং রহ ইবহমধষÿ প্রবে লালন শাহকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, 'অহড়:যবৎ ৎবহড়হিবফ ধহফ :যব সড়ং: সবষড়ফরড়ঁং াবৎংরভরবৎ, যিড়ংব 'ফযুঁধংÿ ধৎব :যব ৎধমব ড়ভ :যব ষড়বিৎ পষধংংবং ধহফ ংঁহম নু নড়ধ:-সবহ ধহফ ড়:যবৎং, ধিং :যব ভধৎ ভধসবফ 'খধষড়হÿ.(প্রাগুপ্ত; পৃ:-৩)।
লালন শাহ কোন মতেই উদাসীন বা সংসারত্যাগী ছিলেন না তা আগেই বলেছি বরং তিনি ছিলেন এর ঘোরবিরোধী। অনেক সাধক সাধনার নামে ঘর ছেড়ে সংসারত্যাগী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। লালন তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, 'ঘরে কি হয় না ফকিরী/কেন রে নিমাই হলি দেশান্তরি/বলে এই কথা কান্দে শচী মাতা/লালন বলে লীলের বলিহারি €' সাধন-ভজনের পথে অনেকে নারীকে বাধা মনে করে নারীসঙ্গ ত্যাগ করার পক্ষপাতি হয়েও সংসার বিবাগী হয়। তাদের উদ্দেশ্য করে লালনের প্রতিবাদ, 'কেউ নারী ছেড়ে জঙ্গলে যায়/স্বপ্নদোষ কি হয় না সেথায়/আপন মনের বাঘে যারে খায়/কে ঠেকায় রে €'
সুতরাং লালন কি ব্যক্তি জীবনে, কি আদর্শগতভাবে কোন প্রকারেই সংসার বিবাগী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং তিনি একজন সচেতন সমাজকর্মী ছিলেন। সমাজের উন্নয়নের জন্য, সমাজের মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাই তাঁর দর্শনজুড়ে কেবলই মানুষের জয়গান, মানবমুক্তির আকুতি। তিনি এই মানুষের বাইরে আর কিছুই বুঝতেন না। তাঁর ধর্মকর্ম, ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল মানুষ কেন্দ্রিক। তাঁর মতে ঈশ্বর যদি থেকেই থাকে তবে এই মানুষের মধ্যেই আছে। লালন বলেন, 'এই মানুষে আছেরে মন/যারে বলে মানুষ রতন।' তিনি যেমন একজন দায়িত্বশীল স্বামী ছিলেন, তেমনি একজন স্নেহপরায়ণ বাবা ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির কিছু অংশ তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকার (পালক কন্যা) পেরিন্নেসার নামে উইল করে যান। এ তো গেল তাঁর সাংসারিক দায়বদ্ধতার কথা, একজন তীক্ষî সমাজ সচেতন সামাজিক আন্দোলনের প্রতিবাদী তিনি নেতাও ছিলেন। সমাজের যেখানেই যে কারো দ্বারা যে কোন অন্যায় সংগঠিত হলেই লালন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন অকুতোভয়ভাবে। এক্ষেত্রে তাঁর ভাবশিষ্য ও বু কাঙাল হরিনাথকে বাঁচানোর কথা তো এখন ইতিহাস।
এহেন সমাজ সচেতন, সংসারী, সামাজিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি যাঁকে বিনা দ্বিধায় সমাজ সংস্কারক বলা যায়, যাঁর সামাজিক আন্দোলন সমাজে এক অপরিহার্য প্রভাব বিস্তার করে সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে; তাঁকে সঠিক প্রাপ্যটা বুঝিয়ে না দিয়ে আর কতকাল পর্দার আড়ালে রাখা হবে বা রাখা সম্ভব হবে সেটিই আমাদের বিবেচ্য বিষয়। লালন শাহের কবিতা যখন বিশ্বসাহিত্যের দরবারে সমাদৃত, লালন শাহের প্রজ্ঞা যখন সকল সুধীজন স্বীকৃত, তাঁর দর্শন যখন বিশ্ব দর্শনের তুল্য, তাঁর সামাজিক আন্দোলন যখন সমাজ পরিবর্তনে অপরিহার্য প্রপঞ্চ হিসেবে বিবেচিত, তাঁর ধর্মীয় আন্দোলন যখন বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে রেনেসাঁর অনুঘটক তখন তাঁকে শুধু বাউল বলে খাটো করে দেখা আর কতকাল! কেন লালন সাঁইজি বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের নায়ক নন? কেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে লালন সাঁইজিকে যোগ্যতরভাবে মূল্যায়ন করা হবে না? কেন তাঁর দর্শনের যথাযথ মূল্যায়ন হবে না? আমরা চাই লালন শাহ তাঁর যোগ্য পাওনাটুকু পাক। একটু বেশিও না কমও না। জোর করে তাঁকে মহাপুরুষ বানানোর পক্ষপাতি আমরা নই, তবে তাঁর অবদানের সঠিক মূল্যায়ন না হওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ও জাতীয় লজ্জা।
লালন ফকির
দিল দরিয়ার মাঝে রে মন
ডুবিয়া দেখলে না।।
রসেতে উবিডুবি থাকে জল
ঐ কুম্ভেতে কেমনে রাখি সে জল
এক বিন্দু টলে না।
সেই ভাটার বেলায় গহীন জলে
জল 'পরে জল মানে না।।
সেই নদীর নালে খালে
আজব এক জাহাজ চলে
বৈসে ত্রিবেণীর কোলে
চালায় জাহাজখানা।
দিবানিশি চালায় জাহাজ
কখন সে ঘুমায় না।।
সেই নদীর ত্রিবেণীতে আজব এক ফুল ফুটেছে
সেই ফুল যার ভাগ্যে আছে
ও ফুরায় তার বাসনা।
ব্রহ্মা বিষ্ণু আর মহেশ্বরে
তাই লালন বলে, ও ফুলের পাহারা তিন জনা।।
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে – লালন ফকির
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখ না রে মন চেয়ে।
দেশ-দেশান্তর দৌড়ে এবার
মরিস্ কেন হাঁপিয়ে।।
করে অতি আজব ভাক্কা
গঠেছে সাঁই মানুষ-মক্কা
কুদরতি নূর দিয়ে।
ও তার চার দ্বারে চার নূরের ইমাম
মধ্যে সাঁই বসিয়ে।।
মানুষ-মক্কা কুদরতি কাজ
উঠছে রে আজগুবি আওয়াজ
সাততলা ভেদিয়ে।
আছে সিংহ-দরজায় দ্বারী একজন
নিদ্রাত্যাগী হয়ে।।
দশ-দুয়ারী মানুষ মক্কা
গুরুপদে ডুবে দেখ না
ধাক্কা সামলায়ে।
ফকির লালন বলে, সে যে গুপ্ত মক্কা
আমি ইমাম সেই মিঞে।
ওরে সেথা যাই
কোন পথ দিয়ে।।
Related posts
তবে তারও আগে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক। সেটা হলো উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে কিংবা সমকালীন গড্ডলিকায়, যার যা প্রাপ্য নয় তাকে সেসব অভিধায় ভূষিত করে ফেললে প্রকৃতযোগ্য জনের জন্যে বিশেষণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। আমাদের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে নিতান্তই অজ্ঞতার বশে 'বাউল গান' শিরোনাম দিয়ে এমন এমন মহান লোক কবি-সাধকের গান প্রচার করে থাকেন, যারা আদৌ বাউল নন। রাধারমণ, হাসন রাজা, জালাল খাঁ, উকিল মুন্সী, শেখ ভানু, দূরবীন শাহ্, শিতালং শাহ, শাহ আবদুল করিমসহ অনেক লোক কবি ও বয়াতি আছেন যাঁরা সন্দেহাতীতভাবেই অনেক উঁচুমানের মরমী সাধক; কিন্তু বাউল নন। তাঁদের কারও জীবনাচরণ বাউলমত বা ধর্মানুগ নয়। তাঁদের বহু গানেই বাউল সাধনার একটি অংশ, দেহতত্ত্বের বিষয় আছে; কিন্তু সেইসব তত্ত্বও প্রকৃত বাউলের জীবন সাধনার যে বিভিন্ন স্তর থেকে উচ্চারিত তার গভীরতাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
বাউল জীবনাচারে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত না হলে তা স্পর্শ করা তো দূরে থাক, অনুভব করাও সম্ভব নয়। বিশেষত কায়া সাধনের স্তরের পর স্তর অতিক্রম, কামকে জয় করে প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করা, দমের নিয়ন্ত্রণ এবং দমকে জিকরে পর্যবসিত করা, বস্তু ধারণ এবং নিজেকে সম্পূর্ণ শূন্য করে দেহের শীর্ষলোক বস্তুরূপ-আরাধ্য দ্বারা পূর্ণ করা প্রথাসিদ্ধ বাউল ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বাউল গানের প্রভাব সর্বপ্লাবী হয়ে পড়ায় বহু মরমী কবির গানে তার ভাবের ছটা একটু-আধটু লেগেছে মাত্র। এমনকি কবি গান, জারি-সারি গান, ভাবগান, বিচ্ছেদি গান, ভাটিয়ালি গানেও বাউল গানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য সেটা যতটা না বাউল গান থেকে, তার চেয়ে বেশি এসেছে সুফিতত্ত্ব থেকে। অথচ এসব রচয়িতার অনেককেই আমরা-বাউল, ক্ষ্যাপা, বাউল শিরোমণি, বাউল সম্রাট অভিধা দিয়ে ফেলেছি নিতান্তই অজ্ঞতার কারণে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গেও এমন অনেক সঙ্কলন বেরিয়েছে, যেখানে প্রচুরসংখ্যক অ-বাউল সাধকের গানকে বাউল গান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেক চারণ গায়ক নিজের নামের সঙ্গে 'বাউল' শব্দটি সংযুক্ত করে নিয়েছেন নেহায়েতই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। যেমন—ভারতের পূর্ণদাস (বাউল)! আত্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে কেউ কেউ পূর্ণদাসকে বাউল সম্রাট (!) বলেও সম্বোধন করে থাকেন। আবার সেই পূর্ণদাস নিজের গলার চাদর খুলে অন্যকে পরিয়ে তাকেও নাকি 'বাউল সম্রাট' বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এসব বালখিল্যতা আবার আমাদের কোনো টিভি চ্যানেল ঘটা করে প্রচারও করে।
এতসব অভিধা, উপাধি, ভূষণের ঠেলাঠেলিতে লালন সাঁইজীকে কী বলে সম্বোধন করব, ভেবে পাই না। তাই তাঁকে আমাদের প্রাণের ফকির—'ফকির লালন সাঁইজী হজরত' বলাটাই আমার কাছে অধিক সঙ্গত মনে হয়। অধিক সম্মানিত আত্মজন বলেও মনে হয় তাতে। কারণ সাঁইজীকে 'শাহানশাহ' বলেও যেন অন্যদের সঙ্গে একটি তুলনামূলক অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যদিও সুফি সাধনায় 'হিকমত' ও 'হুকুমত'-এর বিচারে 'শাহানশাহ' এক অতি উচ্চ পর্যায়। তবু ও প্রসঙ্গ থাক। 'থাক' বললেও প্রসঙ্গ এলেই কিছু প্রাসঙ্গিক কথা এসে যায়। অনেক পণ্ডিতজনই এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালান যে, বাউল মতের উদ্ভব শ্রীচৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদ থেকে কিছুটা বিকৃত হয়ে জন্ম নিয়েছে। এই তথ্য সত্যের কাছাকাছিও সে নয়, তা লালন সাঁইজীর উত্তর সাধক ফকির দুদ্দু সাঁইজীর রচনাতেই স্পষ্ট। তিনি এক স্থানে বলছেন, 'বাউল বৈষ্ণব ধর্ম এক নহে তো ভাই।/বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই\'... অন্যত্র তিনি বাউলের বিবরণ দিচ্ছেন এভাবে—'বাউল জীবন কারে কয়।/কেমন জীবন, বস্তু কি সে জন্ম কোথায় হয়\/সে বস্তু জীবনের কারণ,/তাই বাউল করে সাধন,/জীবন পরম নিরূপণ, বাউলেরা কয়\...' এ ছাড়া শ্রীচৈতন্য নিজেই ছিলেন সুফি প্রভাবিত। এ সম্পর্কে ভিন্ন নিবন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছি। এ দেশে সুফীবাদের প্রতিষ্ঠার তিনশ' বছর পর শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব। ততদিনে গ্রাম-গ্রামান্তরে সুফি সাধকদের খানকাহ্ শরিফ সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। তাঁদের 'শামাহ্', 'কাওয়ালী' ও হেঁয়ালিপূর্ণ গজলের প্রভাব পড়েছে এ দেশের সাধকভাবাপন্ন মানুষের মনে। বাউলের গানেও সেই হেঁয়ালি প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা লালন সাঁইজীর গানে প্রচুর পরিমাণে দৃষ্ট হয়।
পরবর্তী পর্যায়ে শ্রীচৈতন্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদও প্রভাব ফেলে বাউল সাধনার ওপরে। সেই থেকে বাউল সম্প্রদায় প্রধানত দুই ভাগে বিভাজিত হয়ে যায়। বাউল ফকির ও বৈষ্ণব বাউল। ফকির লালন সাঁইজী অবশ্য এই দুই ধারাকেই সম্মিলিত করতে পেরেছিলেন তাঁর সাধনায়। যেমন, নবীতত্ত্ব, তেমনই শ্রীকৃষ্ণ বা গৌরতত্ত্বও তাঁর গানে পাওয়া যায়। এই লক্ষ্মণ তাঁর আগে-পরের অনেক বাউলের মধ্যেও মাঝে মাঝে ঝলক দিতে দেখা যায়। তবে সেসব কোনো রচনাই সাঁইজীর সমকক্ষ নয়। এর মধ্যে একটি বিশেষ বিষয় অতি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। তাহলো—লালন সাঁইজী কোনো গানেই নিজেকে বাউল হিসেবে চিহ্নিত করেননি, বরং বারবার, 'লালন ফকির', 'ফকির লালন' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর দীক্ষাদাতা সিরাজ সাঁইকে 'গুরু' না বলে সম্মান জানিয়েছেন 'দরবেশ' সম্বোধনে। যাই হোক, লালন সাঁইজী উভয় ধারার সম্মিলন ঘটানোর ফলে যেমন গোঁড়া শাস্ত্রবাদী হিন্দু সমাজের কোপানলে পড়েছেন, তার চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন গোঁড়া শরিয়তি মৌলভীদের দ্বারা। এমন কথা উচ্চারিত হয়েছে যে এই ফকির মুসলমানের কেহ নহে। এই একই আক্রমণ, অনেক পরে আমরা লক্ষ্য করেছি আরেক বিস্ময়কর প্রতিভা নজরুলের ওপর। এসব থেকে একটা কথা স্পষ্ট যে, মানবতাবাদী বা মানুষকেই সবার ওপরে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যাঁরা, পৃথিবীর সর্বত্রই তাঁরা ধর্মীয় গোঁড়াদের সঙ্কীর্ণতা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। মনীষী সক্রেটিস থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও শিরশ্ছেদিত সুফি-সাধকরা হয়ে লালন সাঁইজী—কবি নজরুল পর্যন্ত একই ধারা প্রবাহিত।
ফকির শব্দটির অনেক রকম অর্থ আছে। তার মধ্যে মুসলিম সাধক যেমন বোঝায়; তেমনি নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন ভিক্ষুকও বোঝায়। আমি অন্যান্য অর্থ ছেড়ে এই দু'টি অর্থ নিয়েই কিছু বলব। ফকির লালন সাঁইজী যেমন সাধক, তেমনি ভিক্ষুকও। কী ভিক্ষা করেছেন তিনি? স্রষ্টার সঙ্গে মিলন। 'পুত্রাকন্যারূপে' পুনর্জন্ম তিনি চাননি। কারণ তাতে ওপারে যাওয়ার কালে পিছুটান রয়ে যায়। আর পিছুটান নিয়ে নিঃশঙ্কভাবে মিলিত হওয়া যায় না। সর্বশূন্য হয়ে অসীম শূন্যতায় বিলীন হতে হলে যে সাধনার প্রয়োজন হয়—সেটাই বস্তু ধারণের সাধনা। নিজে এ সাধনে প্রবৃত্ত না হলে এ সম্পর্কে শোনা কথায় বিভ্রান্ত হতে হয়। বহু গবেষক নিজে যেমন বিভ্রান্ত হয়েছেন, তেমনি অন্যকেও বিভ্রান্ত করেছেন। সাঁইজীর সাধকসত্তা ও ভিক্ষুকসত্তা অভিন্ন। তিনি স্রষ্টার অন্বেষণ করেছেন মানবদেহের মধ্যে। তাই স্রষ্টাও তার কাছে হয়ে উঠেছেন নানা প্রতীকী নামের মানুষ। আলেখ্য মানুষ, সোনার মানুষ, কাছের মানুষ, অজানা মানুষ, রসিক মানুষ, অচিন মানুষ, নিগুম মানুষ, মনের মানুষ, প্রেমিক মানুষ, অধর মানুষ ইত্যাদি। সেই মানুষ আবার খেলে 'নীরে' ক্ষীরে। সে মানুষকে ধরার জন্য 'দিনের হিসাব'—'তিনের হিসাব করতে হয়।' 'হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে' ত্রিবেণীর তীরে অপেক্ষা করতে হয়।
শরিয়তপন্থীদের হাতে কিছু জগত্খ্যাত সুফি-সাধকের শিরশ্ছেদের পর সুফি-সাধক কবিরা যেমন নানা ধরনের প্রতীকের আড়ালে সাধন পদ্ধতির গীত রচনা করেছেন, লালন সাঁইজীর গানে তেমনি অসংখ্য প্রতীক ও রূপকের ব্যবহার দেখতে পাই। এর আগে অন্য একটি নিবন্ধে তেমন ১০৫টি শব্দের তালিকা দিয়েছি। যেসব শব্দের অর্থ ও প্রয়োগ কৌশল নিয়ে একটি বিশাল গ্রন্থ রচিত হতে পারে। লালন সাঁইজীর সেসব ইঙ্গিতধর্মী শব্দের অর্থও কোনো কারণে কোথায় প্রযুক্ত হয়েছে, তা কায়া সাধনের স্তরের পর স্তর অতিক্রম না করলে নির্দিষ্টভাবে বোঝা সম্ভব নয়। এমনকি সাধারণ শ্রোতাকে ভেদ ভেঙে বললেও তার মর্মে পৌঁছানোর বদলে ভুল বোঝার আশঙ্কা রয়ে যায়। যে কারণে বিশেষত বাউল ফকিরের খেলাফত নেয়া সাধনরত অনুসারীদের কাছেই মাত্রাভেদ ভাঙেন এবং তাও ধীরে ধীরে, যে স্তরে গেলে যতটুকু ভার সইতে পারে ততটুকুই। এসব জ্ঞানের মধ্যে আছে স্রষ্টা-সৃষ্টিতত্ত্ব, আদম সৃজন তার মধ্যে নূরে মোহাম্মদীসহ 'রুহ' স্থাপন, কী কারণে আদমের সম্পূর্ণতা ভেঙে বা দ্বিখণ্ডিত করে 'হাওয়া' সৃজন, দুই-এর মিলনে সম্পূর্ণতার সময় 'কাম' উপজিত হলে কী ফল এবং প্রেম উপজিত হলে কী ফল ইত্যাদি। আছে মিলনের বিভিন্ন পন্থার প্রতীকী বিবরণ। লালন সাঁইজীর গানের এসব তত্ত্ব পণ্ডিত-গবেষকদের রচনায় পাইনি, পেয়েছি আমার একান্ত অনুভবে। এই জীবনচর্চার পথে অগ্রসর হওয়া আমার জন্য এখনও পদে পদে বাধাসঙ্কুল। কারণ এই পথের আহ্বান আসার বহু আগেই আমি স্ত্রী-কন্যাসহ সংসারে নিমজ্জিত। তা ছাড়াও আমার মূল সাধনাটি সুফি ধারার; কিন্তু কীভাবে জানি না, সুফি ফকিরি ও বাউল ফকিরি আমার ভেতরে একাকার হয়ে গেছে। এমন একটি 'ঘোর'-এ আবিষ্ট থাকতে থাকতেই লালন সাঁইজী 'প্রাণের ফকির' বলে প্রতীয়মান হয়েছেন আমার চৈতন্যে আমার মানসলোকে। সেই ভাবসাগরে আমি ডুব দিয়েছি—একথা নিশ্চিত জানি, শুধু জানি না অন্ত পাব কিনা।
কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় লালন স্মরণ উত্সবের শেষ দিন আজ
'আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হোক আমাদের দিন বদলের অনুপ্রেরণা'—এ মর্মবাণীকে সামনে রেখে গত শনিবার ১৬ অক্টোবর থেকে কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় শুরু হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী বার্ষিক লালন স্মরণ উত্সব।এই উত্সবের আজ শেষ দিন। বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহের ১২০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও লালনের ভক্ত, শিষ্য ও বাউলের পদচারণে আখড়াবাড়ি, লালন একাডেমী চত্বরসহ আশপাশের এলাকা উত্সব মুখর ও মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।
বাংলালিংক পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন করেন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলালিংক খুলনার রিজিওনাল কমার্শিয়াল হেড বাবুল হক।
মূল উৎসব শুরু হওয়ার ২-৩ দিন আগে থেকেই আখড়ায় আসা বাউল সাধকরা মাজারের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে গেয়ে চলেছে সাইজির আধ্যাত্মিক মর্মবাণী ও ভেদ তথ্যের গান।সারাদেশ এবং দেশের বাইরে থেকে হাজার হাজার বাউল ও লালন ভক্তরা এসে জমা হয়েছে আখড়া বাড়িতে। কুষ্টিয়া পরিণত হয়েছে উৎসবের শহরে। কালী নদী তীরবর্তী লালন মঞ্চের সামনে আয়োজন করা হয়েছে গ্রামীণ মেলার। বিভিন্ন স্টলের পাশাপাশি থাকছে শিশু বিনোদনেরও ব্যবস্থা।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় উন্মুক্ত মঞ্চে বিশিষ্ট জনদের মুক্ত আলোচনা শেষে গভীর রাত অবধি চলে খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান। রাত যতই গভীর হতে থাকে এখানে মানুষের চাপ যেন ততই বাড়তে থাকে।এই মঞ্চে সাধারনত সাধকদের দেখা যায়না।সাধকরা বেশিরভাগই নিজেদের সঙ্গী সাথীদের নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে গান বাজনা করেছেন।
মেলার এই ক'দিনের মধ্যে গত সোমবার তৃতীয় দিনেই সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম ঘটেছিল। দুপুরের পর থেকে আখড়াবাড়িতে প্রবেশের দক্ষিণ দিকের দবির মোল্লার গেট থেকে পশ্চিমের মিলপাড়া গেট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জনসমুদ্রে পরিনত হয়েছিল এই দিন। আজ শেষ দিন হওয়ায় গতকাল থেকেই কিছুটা ভীর কমতে শুরু করে।
লালনের জন্ম মৃত্যু জাত পাত নিয়ে অনেক বির্তক রয়েছে। বাউলদের এই নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারা এখানে আসেন শুধুমাত্র ভালোবাসার টানে। অনুষ্ঠান শেষে চলে যান আবার নিজ নিজ ঠিকানায়। ফকির লালন শাহের ১২০ তম মৃত্যুবার্ষিকী এবার।জন্ম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও সাপ্তাহিক হিতকরী পত্রিকার মহাত্মা লালন ফকির প্রতিবেদন থেকে পন্ডিতরা অনেকটা নিশ্চিত মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে। তবে ড. আহমদ শরীফ, বসন্ত কুমার পাল, ড. আবুল আহসান চৌধুরী সহ একেক জন পন্ডিত একেক রকম বলেছেন ফকির লালন শাহ সম্পর্কে। অধিকাংশ পন্ডিতদের মতে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়ার ইউনিয়নের ভাড়রা গ্রামে ফকির লালন শাহের জন্ম। হিন্দু কায়স্থ পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহন করেছিলেন। তার পিতা মাধব কর, মাতা পদ্মবতী। যৌবনে তিনি তীর্থ ভ্রমণে বের হয়ে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন এবং ভীষণ অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। তার সাথীরা তাকে মৃত ভেবে নদীতে ফেলে দেয়। তিনি ভাসতে ভাসতে গড়াই নদীর অববাহিকা কালিগঙ্গায় আসেন। এরপর স্থানীয় করিগর সম্প্রদায়ের মলম শাহ নামের এক বুজর্গ ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করেন। মলম শাহ ও তার স্ত্রী লালনকে সেবা যত্নের মাধ্যমে তাকে সুস্থ্য করে তোলেন। মুসলমানের বাড়িতে অন্ন গ্রহন করায় তিনি নিজ বাড়ীতে ফিরলেও তাকে মেনে নেয়নি পরিবার ও হিন্দু সমাজ। ফিরে এসে ছেউড়িয়ার কারিগর সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় তিনি ছেউড়িয়ার আখড়া বাড়ি স্থাপন করেন। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আখড়া বাড়িতেই কাটিয়ে ছিলেন। তবে বিভিন্ন সময় তিনি তীর্থ ভ্রমণ করেছেন বলে জানা যায়। ফকির লালন শাহের মত এবং পথ নিয়ে বিস্তর বিরোধ রয়েছে। কোন কোন পন্ডিত দাবী করেন ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুরে তার জন্ম। কিন্তু অধিকাংশ পন্ডিত একমত কুষ্টিয়ার ভাড়রা গ্রামে জন্মের ব্যাপারে। ফকির লালন শাহের অনুসারীরা মূলত সহজিয়া। তারা যা পেতে চান তাও সহজ আনন্দ। তাদের সাধন প্রণালী বক্র নয় সহজ দেহ। তারা মনে করেন আত্মার মাঝে পরমাত্মার স্থিতি। যেহেতু আত্মার স্বরূপ বিশেষণ সম্ভব নয় তাই দেহ যন্ত্র বিশেষণ করে পরামাত্মার সন্ধান লাভ করা হয়।
ব্রিটিশ শাসন আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিবেধ সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরুধ্যে প্রতিবাদী কন্ঠ। তিনি মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ এ বিশ্বাস করতেন না। তাঁর কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এসবের কোন দাম ছিলনা। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী।বাউলদের জন্য তিনি যেসব গান রচনা করেন, তা কালে কালে এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে মানুষ এর মুখে মুখে তা পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
আজ উত্সবের শেষে সবাই ফিরে যাবে নিজ নিজ গন্থব্যে।আবারও বসবে ভক্তদের এই মিলনমেলা।ভক্তদের ভালোবাসা আর শান্তির বাণী নিয়ে লালন শাহ মানুষের মনে বেচে থাকবে চিরদিন।
http://www.swapnershiri.com/magazine/latest-news/lalon-shah/
লালন-রবীন্দ্র সাক্ষাৎকার দ্বন্দ্ব
বাউল দর্শন ও সঙ্গীত বাংলার অনেক কৃতী পুরুষকেই আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবল বিমহিত হয়েই থেমে থাকেন নি। স্বীয় সত্তার সাথে গেঁথে নিয়েছিলেন বাউল মতবাদ। বাউল গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছিলেন মানবতাবাদী জীবনচেতনার প্রেরণা। আর ধীরে ধীরে তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন "রবীন্দ্রবাউলে"। বাউল গানের সুর,বাণী ও তত্ত্বকথা যেমন তাঁকে আকৃষ্ট করেছে, তেমনি বাউলের বেশভূষায় তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। আমরা দেখতে পায় এক সময় বাউল ঢঙ্গের পোশাকই হয়ে উঠেছিলো তার নিত্য ব্যাবহার্য। রবীন্দ্রমানসে এই বাউল প্রভাবের মূলে লালনের গান ও তাঁর শিষ্য-সম্প্রদায়ের সাহচর্য সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিলো বলে মনে হয়। মরমিসাধক লালন ও রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ সম্পর্কে দ্বিমত বিদ্যমান। কারো কারো মতে রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আবার কেউ কেউ তথ্য-প্রমাণের অভাবে কেবল জনশ্রুতি ও অনুমানের উপর আস্থা রাখতে পারেন নি। লালন-রবীন্দ্র সাক্ষাৎকার সম্পর্কে প্রথম ঘোষণাটি আসে জলধর সেনের(১৮৬০-১৯৩৯) কাঙাল-জীবনীতে। তিনি লিখেছেনঃ
"শুনিয়াছি, কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিতে লালন ফকির একবার গান করিয়া সকলকে মন্ত্রনুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। প্রাতঃকাল হইতে আরম্ভ করিয়া অপরাহ্ন তিনটা পর্যন্ত গান চলিয়াছিল; ইহার মধ্যে কেহ স্থান ত্যাগ করিতে পারে নাই"।
অন্যত্র বসন্তকুমার পালের 'মহাত্না লালন ফকির' গ্রন্থে 'প্রকাশকের নিবেদনে' অজিতকুমার স্মৃতিরত্ন উল্লেখ করেছেনঃ
"নিরক্ষর পল্লীবাসী হইতে আরম্ভ করিয়া আমরা শুনিয়াছি জ্ঞানবৃদ্ধ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ফকিরের সহিত ধর্ম্মালাপ করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছেন। শিলাইদহে মহাকবি রবীন্দ্রনাথের সহিত প্রথম যেদিন তাঁহার ভাবের বিনিময় হয় তাহা জাহ্নবী-যমুনা-মহামিলনের ন্যায় রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গমতীর্থ রচনা করে"।
বিনয় ঘোষ সাক্ষাৎকারের সপক্ষে তা৬র মত প্রকাশ করেছেনঃ
"১৮৮৪-৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বাউল্গানের সংগ্রহটি তার (রবীন্দ্রনাথ) হাতে পড়ার পর যখন বাংলা লোকসাহিত্যের গোপন রত্নভান্ডারের দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল, তার দু-তিন বছরের মধ্যেই মনে হয়, শিলইদহে বিখ্যাত বাউল লালন ফকিরের স্পঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিলো"।
আনোয়ারুল করীম, সুকুমার সেন, মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন, রাসবিহারী জোয়ারদারও লালন-রবীন্দ্র সাক্ষাতের সপক্ষে অভিমত ব্যাক্ত করেছেন। কিন্তু উপরিউক্ত মন্তব্য-অভিমত সবই কল্পিত, অনুমান কিংবা জনশ্রুতি নির্ভর। কেউই তাদের বক্তব্যের সমর্থনে কোনো তথ্য-দলিল উপস্থিত করতে পারেন নি। লালন-রবীন্দ্র সাক্ষাৎকারের ধারনাটি নানাকরনে অনেকেই সমর্থন করেন নি। হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন" আমার মনে হয় এই কাহিনী সম্পূর্ণ কিংবদন্তীর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে"। অন্নদাশঙ্কর রায়ও এ-বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এই ব্যাপারে তার ভাষ্য " দুই জ্যোতিষ্কের সাক্ষাৎকার প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ"। সাক্ষাৎকার সম্পর্কিত দ্বন্দকে আরো বেশি জটিলতর করেছে রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ বিপরিত দুটি মন্তব্য। ১৯২২ সালে শান্তিদেব ঘোষের পিতা কালীমোহন ঘোষকে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেনঃ
"তুমি তো দেখেছো শিলাইদহতে লালন ফকিরের শিষ্যগনের সহিত ঘণ্টার পর ঘন্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত"।
এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট ভাবেই বুঝা যায় রবীন্দ্রনাথ লালনের সাথে নয় তাঁর শিষ্যদের সাথেই দেখা সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু অন্যত্র, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তার সচিব সুধীরচন্দ্র কর ২০ জুলাই ১৯৩৯ বসন্তকুমারকে এক লিখিত পত্রে জানানঃ
সবিনয় নিবেদন,
কবি আপনার চিঠি পেয়ে সুখি হয়েছেন।আপনাকে এই মহৎ কাজে সাহাজ্য করতে পারলে তিনি আরো সুখি হতেন সন্দেহ নাই। ফকির সাহেবকে তিনি জানতেন বটে কিন্তু সে তো বহুদিন আগে; বুঝতেই পারেন এখন সে সব সুদূর স্মৃতির বিষয় তার মবে তেমন উজ্জ্বল নয়।........................"
'ফকির সাহেবকে (লালন) তিনি (রবীন্দ্রনাথ) জানতেন'— এই উক্তিটি অবশ্য উভয়ের আলাপ-পরিচয়ের ধারণাকে সমর্থন করে। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে জমিদারীর দায়িত্বভার নিয়ে আসেন ১৮৯০ সালের শেষের দিকে, লালনের মৃত্যু ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর। সুতরাং ঐ সময় উভয়ের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে বাল্যকাল থেকেই শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের আসা-যাওয়া ছিলো, তখন তাদের দেখা হলেও হতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত তথ্য প্রমাণাভাবে তাদের এই ঐতিহাসিক সাক্ষাতের ঘটনাটি গ্রহনযগ্যতা পাচ্ছে না।
রেফারেন্সঃ লালন সাঁই-আবুল আহসান চৌধুরী।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত লালনের প্রতিকৃতিঃ ১৮৮৯
মন্তব্য সমূহ
http://www.amrabondhu.com/nahid2k/358
আপনার এ লেখাটি সম্পুর্নভাবেই অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী রচিত গবেষণামূলক বই 'লালন সাঁইয়ের সন্ধানে'(পলল প্রকাশনী-২০০৭) এর 'ঠাকুরকবির লালনমনস্কতা : কতদিন দেখেছি ওদের সাধককে' এই প্রবন্ধ থেকে সচেতনভাবে সংক্ষেপিত!
"লালন-রবীন্দ্র সাক্ষাৎকার দ্বন্দ্ব" লেখাটি নেয়া হয়েছে আবুল আহসান চৌধুরীর "লালন সাঁই"(সূচীপত্র প্রকাশনী-২০০৮) গ্রন্থের "দুই বাউলঃ লালন-রবীন্দ্রনাথ" প্রবন্ধ থেকে।
আবুল আহসানের লেখা থেকে তথ্যগুলো নিয়ে যদি বর্ণনাটা অন্তত নিজে করতেন তাহলে উক্ত শব্দ(মেরে দেয়া) ব্যাবহারের প্রয়োজন ছিল না। এক্ষেত্রে আমি হৃদয়ের সাথে একমত 'মূল তথ্য নিয়ে নিজের মতো করে লিখলেই হতো। আপনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ করতে পারতেন'। এবং শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই মুল লেখাটিকে 'রেফারেন্স' বলা/ধরা যেত। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখেছি, আপনার ব্যাবহৃত একটি শব্দও আবুল আহসানের লেখায় অনুপস্থিত পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে আমি বকলম কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আশা করছি।
প্রথমত, অন্য কোন লেখকের লেখা 'কাট-ছাট করে সংক্ষিপ্ত রূপে' টাইপ করে নিজের কোন আলোকপাত ব্যাতীত বকলমে 'শেয়ার' করা যায় কিনা?
দ্বিতীয়ত, নীতিমালার ১১নং পয়েন্টে যা বলা আছে('অন্যের কোন লেখা এখানে প্রকাশ করতে গেলে অবশ্যই মূল লেখকের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করতে হবে, এবং উৎসের রেফারেন্স উল্লেখ করতে হবে'), সেখানকার দুইটি নির্দেশনার যেকোন একটি মানলেই চলবে কিনা?
এই লেখাটি ঠিক কতদিনের পুরানো, কিংবা লেখক জীবিত নাকি মৃত তা বকলমের কর্তৃপক্ষ অবগত নয়। লেখকের মৃত্যুর পর যদি ৫০ বছর অতিক্রান্ত না হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই এই লেখা কপিরাইটের দায়ে দুষ্ট। সেক্ষেত্রে খান অনির্বাণকে লেখাটি পরিবর্তন করতে অনুরোধ করছি, অন্যথায় তা মুছে ফেলা আবশ্যক।
উপরোক্ত দুই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনার উত্তরের অপেক্ষায় আছি আমরা। অন্য কোন উৎস থেকে লেখাটি নেয়া হলে অবশ্যই সেই উৎসের উল্লেখ করা উচিত আপনার লেখায়। সেক্ষেত্রে লেখাটি সম্পাদনা করে শিঘ্রই লেখার নিচে উৎসের উল্লেখ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
- বকলম এডমিন
প্রসঙ্গত বলি, আমি যতোদূর জানি রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের ঠিক মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। এবং এ ব্যাপারে গুজবেরও কোন গাছপাথর নেই।
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজী
সবই দেখি তানা না না।।
সময়ের কালপর্বে প্রায় দুই শতক বছরেরও অধিক পূর্বে নিতান্তই সাধারন এক অজঁ পাড়াগায়ের প্রিয় কুটিরে বসেযে মানুষটি সৃষ্টি করেছেন আত্মদর্শন ও মানবতাবাদী এরকম অসংখ্য পদ আর উপহার দিয়েছেন নতুন একআধ্যাতিকতা ও আত্মদর্শনের জগত, তিনিই ফকির লালন শাহ্। চরম অস্তিত্ত্ব ও পরম তত্ত্বের সন্ধানী লালনছেউড়িয়ার আখড়াতেই প্রকাশ করেছিলেন তার ঐশি জ্ঞানের এইসব দিব্যবানী। গেয়েছিলেন সেই অমর সত্ত্বার প্রসস্তিগীত -
এলাহী আলামিন গো আল্লাহ, বাদ্সা আলমপানা তুমি।
তুমি ডুবায়ে ভাসাইতে পার
ভাসায়ে কিনার দাও কারো
রাখ মার হাত তোমার,
তাইতে তোমায় ডাকি আমি।।
<!--[if !supportLineBreakNewLine]-->
<!--[endif]-->
সেই পরম সত্ত্বার প্রসস্তি গাইতে গাইতে এভাবেই শুরু হয় বাউল সম্প্রদায়ের আসর সাধুসঙ্গ। প্রার্থনার মাধ্যমে স্রষ্টারউপর সম্পুর্ন সমর্পন করে অনাসক্ত দেহ তত্ত্ব সাধক স্রষ্টার কাছে তার আর্তি পেশ করেন। প্রার্থনামুলক
এ ধরনের অজস্র বাস্তব সঙ্গীতে লালন সাইঁজীর জ্ঞানের গভীরতা ও সৃষ্টিকর্তার প্রকৃত ও বাস্তব ক্ষমতারঅবস্থানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
সাইঁজী লালনের সঙ্গীতগুলো চরম জ্ঞানবাদের, দেহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন ও সকল
অন্তর্মূখী অবস্থাকে লক্ষ করে বিস্তারিত প্রসঙ্গমূলক সঙ্গীত -
আট কুঠুরী নয় দরজা আটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায় ।।
দেহ তত্ত্বই বাউল সম্প্রদায়ের মূল ভিত্তি। দেহই সকল রহস্যের মূল। দেহকে দেখার অর্থ দেহকে পাঠ করা বাআত্মদর্শন করা। আপনাকে জানার মাধ্যমে পরম সত্তার অস্তিত্ত্ব জানা যায়। লালন পরমাত্মাকে উপলব্ধি করেছেনআপন অস্তিত্ত্বের মধ্যে এবং বিশ্বাস করেছেন, অস্তিত্ত্বের রহস্য গভীরভাবে ও একনিষ্ঠভাবে দেখলে, পাঠ করলে ওআত্মদর্শন করলে অচেনার সাথে সংযোগ হতে পারে। তাই সত্যকে জানা ও পাওয়ার মাঝখানে একমাত্রদেহকেই অবলম্বন করেছেন পরম প্রাপ্তির উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।
সাইঁজী লালনের সঙ্গীতে ধর্মীয় সাধনার মূল ধ্যানতত্ত্বে শ্বাস-প্রশ্বাস বা দমের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে,লালন বলেন -
ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে
সে কি সামান্য চোরা
ধরবি কোনা কাঞ্চিতে।।
দেহের যতক্ষন শ্বাস ততক্ষন আশ বলে একটি প্রবাদ রয়েছে।
হাওয়া বা দম বন্ধ হলেই তা মৃত। বাউল সম্প্রদায় হাওয়ার গতিধারা
নিয়ন্ত্রনের জন্য যোগ সাধন ও সার্বক্ষনিক ধ্যানের উপাদান হিসেবে আপন সত্তার রকম ও
প্রকারের উপর সর্বদা সচেতন। বাউল নিজস্ব অবস্থানে অবলোকন করে হাওয়া নামক অস্থির
পোষা পাখীটিকে। এই হাওয়াই হলো মনের চলাচলের পথ। সাধকের দেহ-মন, হাওয়া ও
আত্মতত্ত্বকে জ্ঞানের উপাদান হিসেবে না জেনে ভজন সাধন বৃথা। মন
আদৌ ধ্যানে ও জ্ঞানে থাকতে চায় না। তাই লালনের অমিয় বানীতে সাধক পায় অস্থির দেহ
মনের সাধনার শক্তি।
সাইঁজী লালনের সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে মানুষের ধর্ম,
সম্প্রদায় ও স্রষ্ঠার নানাবিধ শব্দে ও নামে পরিচয় এবং আবেগ আপ্লুত হয়ে বাহ্যিক
দৃষ্টিতে রচিত হয় নাই। লালন সর্বযুগের ও সর্বকালের মানুষের জন্য তত্ত্বের রূপরেখা
অবলোকন করে পদ রচনা করেছেন। তার আধ্যাত্মবাদে কোন ভেদজ্ঞান
নাই। তিনি বলতে চেয়েছেন -
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খৃষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।।
মানুষের ভেদ সৃষ্টি, ধর্ম সৃষ্টি, সম্প্রদায় সৃষ্টি ও স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে
বিভিন্ন নাম প্রদানের কুফল লালন অত্যন্ত দুরদর্শিতার সাথে বর্ননা করেছেন তার
সজ্ঞীতে। আল্লাহ্, হরি, ভগবান, ঈশ্বর শব্দগুলো শুধু মুখে উচ্চারন করে আল্লাত্ব
অর্জন হয় না। একই মানুষ শুধুমাত্র ভেদজ্ঞানে বন্দী হয়ে আমিত্বের জালে ভিন্নতর।
অত্যন্ত স্বার্থপর ভাবে মানুষ শুধু আগুন, বাতাস, পানি, মাটি ও ধর্মকেই
ভাগ-বাটোয়ারা করেনি, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সীমানাকে পৃথক করে আমিত্বের শক্তিকে
দানবে রুপান্তরিত করেছে। বাউল ধর্ম এই ভেদজ্ঞানের অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত। আমিত্বের
স্থান বাউল ধর্মে নাই। সাইঁজী বলেন -
গঙ্গায় গেলে গঙ্গা জল হয়
গর্তে গেলে কুপ জলই কয় বেদ বিচারে
তেমনি সাইঁর বিভিন্ন আকার
জানায় পাত্র অনুসারে।।
একে বয় অনন্তধারা
তুমি আমি নাম বেওয়ারা ভবের পরে
লালন বলে আমি কে বা
জানলে ধাঁধা যেত দূরে।।
বাউল সুর মরমী সঙ্গীতে সাধকের সাধনার জন্য ভাব তৈরীতে আশ্চর্য ফলদায়ক।
লালন মুক্তির রহস্য উদ্ধার করে উপমা, রুপক ও ভাবের ভাষাতেই পদ রচনা করেছেন। যেমন -
তিন পাগলে হলো মেলা
ন'দে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।।
লোভ, দ্বেষ, মোহ হলো তিন পাগল আর এই তিন পাগলের সহাবস্থানেই দেহে সৃষ্টি
সংস্কার। অস্তিত্ত্বের আকার নিভিয়ে দেয়ার জন্য এই তিন পাগল সর্বদাই ব্যস্ত। সাইঁজী
লালন তাই এই অজ্ঞানী, অধ্যানী ও বিকার দেহ মনের পাগলদের নিকট না যাওয়ার
জন্য সাবধান করেছেন। রিপু ইন্দ্রীয় বশবর্তী হয়েই অস্তিত্ত্ব সমর্পিত হয় জগতের সকল
কর্মে ও ধর্মে। ধ্যানের উপকরন না থাকায় আপন অস্তিত্ত্ব আহত হচ্ছে রিপু ইন্দ্রীয়ের
নিকট। আল্লাহ জাগ্রত হচ্ছে না আর অবিকল জাতের সাথে একাকার না হওয়ায়
তৈরী হচ্ছে অজাত, বেজাত। পাগলের স্বভাব, আচরন ও ব্যবহার সম্পুর্ন
আসক্তির মধ্যে বন্দী। তাই সবার আগে ইন্দ্রীয় দ্বার দিয়েই খালি বা শুন্য করতে হবে
দেহ মনের সংস্কার। তবেই মিলবে আপন ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লাহ্কে। সাইঁজীর আকুল আর্তি
-
মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে।।
সকল লোকসমাজই তত্ত্বগত প্রার্থনায় আপনার খবর কোথায় তা জানতে চায়।
মনের মানুষের সঙ্গে মিলন ঘটবে কবে এ প্রশ্ন সবার। মনের মানুষের সঙ্গা কি এবং মিলন
হবে কত দিনে-এর রহস্য ভেদ করারই চেষ্টা করেছেন বাউল সম্রাট তার পদগুলোতে।
মনের মানুষের সঙ্গে মিলন ঘটানোর জন্যই সাধকের সব সাধন ভজন। সৃষ্টিকর্তার
সকল শক্তি যেমন পরিপুর্ন জ্ঞানাকারে নবী ও আদমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে বার বার, তাই
মানুষ তত্ত্বই মূল হিসেবে বিবেচনা করেছেন লালন। মানুষ যেমন সৃষ্টির রহস্য তেমনি
স্রষ্টাও সৃষ্টির রহস্য। মানুষের মধ্যেই মানুষ রুপে অবতার, সাঁই বিরাজ করেন
ত্রি-ভূবনে। তাই লালন পরিপূর্নভাবে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে দুরত্ব না রেখে সাধন ভজনের বলে
পরমতত্ত্বের গুনাবলিতে মানুষকেই মনের মানুষ হিসেবে তুলনা করেছেন এবং মানুষেরই
জয়গান করেছেন মুক্তি ও নাজাতের উপায় অবলম্বন হিসেবে। তার গানেই রয়েছে -
যখন ঐ রুপ স্মরন হয়
থাকে না লোক লজ্জার ভয়
অধীন লালন ভেবে বলে সদায়
প্রেম যে করে সে জানে।।
বাউল মতে শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়, আচার অনুষ্ঠান ও বিধি-বিধানের চেয়ে
মানুষ বড়। আত্মসত্ত্বার মাঝেই নিহিত রয়েছে পরমাত্মার ঠাই। মানুষের মধ্যেই নিহিত
মানুষ রতন, আলেক সাঁই। পরমাত্মার স্বরুপ সেই অসীম আলেক সাঁইকে খুঁজে
পেতে হবে সসীম মানুষেরই মধ্যে।
লালন সাঁইজীর রচিত পদ বা সঙ্গীতে সুর, ছন্দ, পদ ইত্যাদি নানাবিধ বিন্যাসের
প্রকৃত ও আলঙ্কারিক সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে আত্মদর্শনের কারনে। অস্তিত্ত্ববোধই লালনের
সঙ্গীতের মৌলিক রহস্য। তাই লালনের সঙ্গীতে লালনের নিজস্ব উপলব্ধিই মহান দিকদর্শন
হিসেবে সাধকের সাধনার অনুপ্রেরনা হিসেবে কাজ করে। আপনাকে জানার রহস্যই লালনের
সঙ্গীতের আহ্ববান। এ সব কিছু চিন্তা করলে বলা যায়, লালনের অসাধারন সঙ্গীতগুলো
মানুষের মধ্যে আত্মদর্শনের সাধ সৃষ্টিতে অনেক বড় ও কার্যকর ভূমিকা রাখে। আর এ
সবই সম্ভব হয়েছে মরমী সঙ্গীতে মানুষের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের চেষ্টার
কারনেই। লালন একাই সকলের হয়ে উপলব্ধির বানী প্রদান করেছেন সত্ত্বার আদি
রহস্যের দর্শনে। চেষ্টা করেছেন জাতি, ধর্মের উর্ধে উঠে মানুষকে সৃষ্টিকর্তার
কাছাকাছি পৌছানোর উপায় প্রদর্শনের।
১৮৯০ইং সালের ১৭ই অক্টোবর বাংলা ১২৯৭ সনের ১লা কার্তিক
ছেউড়িয়ার আখড়াবাড়ীর এই গানের পাখীটা চিরদিনের জন্য পালিয়ে গেল ইহজগতের মায়া থেকে।
মুখে ছিল তার রচিত শেষ গানের শেষ বুলি -
পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে
ক্ষম হে অপরাধ আমার
এ ভব কারগারে।।