'সাদাত হাসান মান্টো সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের কথা বলতেই হবে। কেননা দেশ ভাগ মান্টোর সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন সাহসী ও শাণিত লেখক। সাহিত্য মায়ার জগতে নিয়ে যায় পাঠককে। কিন্তু মান্টো সেই মায়ার জগৎ থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসেন মানুষকে। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছেন, পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের ক্ষমতাসীনদের ব্যঙ্গ করেছেন। যেমন তার "টোবা টেক সিং" গল্প তার প্রধান উদাহরণ।' জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলিআমি কেন লিখিমূল : সাদাত হাসান মান্টো অনুবাদ : জাফর আলম আমি কেন লিখি? এটা এমন প্রশ্ন, যেমন আমি কেন খাই_কেন তৃষ্ণা মিটাই। যদি এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়, তাহলে খাওয়া-দাওয়া আর তৃষ্ণা মিটানোর জন্য টাকা ব্যয় করতে হবে। যদি আমি এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য গভীর থেকে গভীরতরে প্রবেশ করি, তখন বুঝতে পারি, আমি ভুল। কারণ টাকার জন্য আমাকে লিখতে হয়। আহার যদি সংগ্রহ করতে না পারি, তবে আমার দৈহিক অবস্থা এমন থাকবে না_কলমও ধরতে অক্ষম হব, না খেয়ে উপোস করে চিন্তা-চেতনা চালু রাখা যেতে পারে; কিন্তু হাত তো সবল রাখা প্রয়োজন। যদি হাত না চলে, তাহলে মুখে কথা বলা চালু থাকুক। মানুষ ভুখাপেটে কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না, এটাই হলো মানুষের এক ট্র্যাজেডি। শিল্পকলাকে মানুষ অনেক উচ্চে স্থান দিয়েছে। এর যে পতাকা তা স্বর্গে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু এ কথা অবিস্মরণীয়ভাবে সত্য যে প্রতিটি শ্রেষ্ঠ এবং মহান জিনিসই এক টুকরো রুটির জন্য উদগ্রীব। আমি কিছু বলতে চাই, তাই আমি লিখি। আমি কিছু রোজগারের জন্য লিখে থাকি এবং রোজগার করি_তাই অনেক কথা বলতে পারি। রুটি ও শিল্পকলার যে সম্পর্ক তা আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত বলে মনে হয়; কিন্তু কোনো উপায় নেই। খোদা তায়ালা এই দুয়ের সম্পর্ক এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তিনি স্বয়ং নিজেকে সবই বস্তনিরপেক্ষ বলেছেন অথচ এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। এই নিরপেক্ষতা ও নির্লিপ্ততা সঠিক নয়। এর জন্য ইবাদত অথবা প্রার্থনা প্রয়োজন। আর এই আরাধনা খুবই কোমল ও স্পর্শকাতর রুটির মতো। অতএব, বলতে পারেন, এটা যেন ঘিয়ে ভাজা রুটি আর যে রুটি দিয়ে তিনি উদরপূর্তি করেন। আমার প্রতিবেশী কোনো মহিলা যদি প্রতিদিন তাঁর স্বামীর হাতে মার খেয়ে আবার স্বামীর জুতা পরিষ্কার করেন তার জন্য আমার হৃদয়ে কোনো দয়া বা অনুকম্পা থাকতে পারে না। কিন্তু আমার প্রতিবেশী যে মহিলা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেন ও হুমকি দিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যান। আর দুই ঘণ্টার মতো সময় স্বামীকে অস্থির ও উদ্বিগ্ন দেখতে পাই। তখন তাঁদের দুজনের জন্যই আমার মনে বিচিত্র ধরনের অনুভূতি ও বেদনার সৃষ্টি হয়। যদি দুজন যুবক-যুবতীর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে, আমি তাঁদের সর্দি হয়েছে বলে মনে করি না। কিন্তু ওই যুবককে আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে যেন তার জন্য হাজারো মেয়ে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। আসলে যে বাংলার দুর্ভিক্ষ মানুষের মতো ভালোবাসার কাঙাল। এই প্রেমিক তার ভালোবাসার রঙিন কথার ফুলঝুরির মধ্যে গুমরে উঠা কান্নাকে ধরে রাখে, তা আমার হৃদয়ের কান দিয়ে শুনব আর অন্যকেও শোনাব। চাকায় গম পেষাইকারী যে মহিলা দিনরাত পরিশ্রম করেন ও রাতে আরামে ঘুমান তাঁরা আমার কাহিনীর হিরোইন হতে পারেন না। আমার গল্পের নায়িকা হচ্ছে পতিতালয়ের বেশ্যা, যে সারারাত জেগে থাকে আর দিনে ঘুমায়। আর ঘুমের মধ্যে কখনো ভয়ানক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে, যেন সে বুড়ি হয়ে গেছে আর বুড়ো বয়সের দিনগুলো যেন তার ঘরের দরজায় টোকা মারছে। তার ভারী চোখের পাতার ওপর অনেক বছরের ঘুম জমাট বেঁধে আছে। আর তারাই হলো আমার গল্পের বিষয়বস্তু। তার অসুস্থতা আর খিটখিটে মেজাজ, ওর অশ্লীল গালিগালাজ_সব কিছু আমাকে মুগ্ধ করে। তাই আমি তাদের নিয়ে লিখি। ঘরোয়া মেয়েদের আলসেমি ও তাদের ন্যাকামি, সুন্দর স্বাস্থ্য আমার পছন্দ নয়। সাদাত হাসান মান্টো লিখেন কারণ তিনি সৃষ্টিকর্তার মতো মস্তবড় গল্পকার কবি নন। তাঁর ভালোবাসা আর মমতা তাঁকে লেখার জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়। আমার জানা আছে, উর্দু সাহিত্যে আমার ভীষণ খ্যাতি আর সুনাম আছে। যদি জীবনে এই আনন্দ ও উৎফুল্লতা না থাকে, তবে জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়ত। আমার দেশ_পাকিস্তান। যেখানে আমি থাকি, যেখানে আমি আমার দাঁড়ানোর স্থান তা আজও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। সেজন্য আমার রক্ত সর্বদা চঞ্চল থাকে। আমি কখনো পাগলা গারদে অথবা হাসপাতালে দিন কাটাই। আমাকে সর্বদা প্রশ্ন করা হয়, আমি কেন মদ পান করা ছাড়তে পারি না। আমি আমার জীবনের তিন-চতুর্থাংশ খারাপ সংসর্গে কাটিয়ে দিয়েছি। আমার এখন এমন অবস্থা যে 'খারাপ সংসর্গ' থেকে দূরে থাকা শব্দটি আমার অভিধান থেকে উধাও হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, খারাপ সংসর্গ বাদ দিয়ে আমি যদি এখন দিন কাটাই, তবে আমার জীবন হয়ে উঠবে জেলখানার বন্দির মতো, আর যদি খারাপ সংসর্গ কেটে যায়, তাহলে তাও হবে জেলের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু নয়। তাই কোনো না কোনোভাবে যদি আমি মোজার সুতার একটা দিক টানতে টানতে বেঁচে যাই, তা হবে আমার জন্য মঙ্গলকর। [মান্টোর জন্ম ১১ মে, ১৯১২ ভারতের লুধিয়ানা জেলার সোমরালে। মৃত্যু ১৮ জানুয়ারি, ১৯৫৫ সালে লাহোরে। জন্ম তারিখ অনুযায়ী ১১ মে, ১৯১২ মান্টোর জন্মশততমবার্ষিকী। 'আমি কেন লিখি' লেখাটি অনুবাদকের মান্টোর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।] খুল দো, ঠাণ্ডা গোস্ত কিংবা খুদা কি কসম আন্দালিব রাশদী আমরা সে ভাবে তাঁকে পড়লামই না |
অথচ সাদাত হাসান মান্টো কেবল দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার নন, এই উপমহাদেশের জীবনে তিনি আজও ভয়ানক ভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর জন্মের শতবর্ষ চলে গেল, মোটামুটি নিঃশব্দেই। |
সাদাত হাসান মান্টো-কে উপমহাদেশের দাঙ্গা ও দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কথাকার বললে এত দিনে মনে হয় কেউ আর আপত্তি করবে না। দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার, দাঙ্গার আতঙ্ক, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বিদ্বেষ এত নিপুণ দরদে আর কে-ই বা চিত্রিত করেছেন? দুর্ভাগ্য আমাদের, মান্টোর অধিকাংশ রচনাই উর্দুতে, আর সেকুলার ভারত শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের এই জাতীয় ভাষার চর্চাকে সর্বতোভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। তাই ইংরাজি অনুবাদে, ইংরাজি-শিক্ষিত সাহিত্যপাঠকের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে মান্টো সে ভাবে চর্চিত হলেন না। পাকিস্তানে যখন ইদের বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্যেই সংখ্যালঘু হিন্দুদের মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়, পরিবারের মেয়েদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে নেয় ক্ষমতাবানরা, ট্রেনে চেপে ভারতে পালানোর সময় জানলা দিয়ে তাদের প্রতিবেশীরা হাত নাড়ে শেষ বার জীবিত দেখতে পাওয়া স্বজনদের উদ্দেশে, মান্টোর কথা মনে পড়ে। তার পাসপোর্ট করাতে না-পারায় তিন দিনের নবজাতককে প্রতিবেশীর কাছে বরাবরের জন্য রেখে দিয়ে এক হিন্দু মা যখন সাশ্রুনয়নে প্রয়াগের কুম্ভ মেলা দেখার পর্যটক-ভিসা নিয়ে রাজস্থান সীমান্ত পেরিয়ে বাকি সন্তানদের বাঁচাতে এ দেশে থেকে যেতে চান, স্বাধীনতা ও দেশভাগের মান্টো-কৃত বিশ্লেষণ বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ভাগলপুরে দাঙ্গায় নিহতদের শব মাটি-চাপা দিয়ে যখন তার উপর কচি-সবুজ ধানের চারা রোপণ করা হয়, 'জয়শ্রীরাম' বলতে অস্বীকৃত ইমামের ধড়মুণ্ড আলাদা করে সুরাতে যখন তাঁর আজীবন বোরখাবৃত স্ত্রীকে নগ্ন করে গণধর্ষণ করার চলচ্চিত্র ভিডিও-বন্দি করে যৌথ উপভোগ করা হয়, বা গুজরাতে জীবন্ত সংখ্যালঘু পোড়ানোর সময় 'হর-হর-মহাদেব' ধ্বনি ওঠে, সেই পৈশাচিকতাকে পোকায়-কাটা স্বাধীনতায় বিভক্ত উপমহাদেশে বড়ই মান্টো-প্রতিম মনে হয়। হ্যাঁ, সাদাত হাসান মান্টোর— কেবল 'টোবা টেক সিং' নয়— আরও অনেক গল্পের মতোই শ্লেষপূর্ণ ও পরিহাসময়। জালিয়ানওয়ালাবাগের শহর অমৃতসরে মান্টোর জন্ম (১১মে, ১৯১২) ও বড় হওয়া। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিবাদীদের দলে ভিড়তেও রাজনীতিসচেতন এই নবীন কিশোরের সময় লাগেনি। কিন্তু প্রগতি লেখক সংঘের ছকে-বাঁধা সাহিত্য, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতায় আটকে থাকেননি এই কথাকার। সমাজের নিচুতলা অর্থাৎ পানওয়ালা, দোকানদার, ড্রাইভার, ধোপা, দালাল, বেশ্যা ও অসংগঠিত শ্রমজীবীদের পাশাপাশি ওপরতলার গ্লানি ও পাপ, রিরংসা ও নিঃস্বার্থতার মিশ্র জীবনই তাঁকে আকৃষ্ট করে বেশি। তাঁর 'গন্ধ' গল্পটিতে যেমন বিত্তবান তরুণ রণধীর এক বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যায় ভিজে-কাপড়ের মজদুরনিকে তার বিলাসবহুল ঘরে আশ্রয় দিয়ে কালক্রমে সম্ভোগে লিপ্ত হয়। এই যৌনতায় সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে তার ঘামে-ভেজা শরীরের দুর্গন্ধ, যা রণধীর নিজের সর্ব শরীর ও চেতনা দিয়ে আকণ্ঠ পান করে। গল্পের শেষে জেলাশাসকের গ্র্যাজুয়েট কন্যার সঙ্গে বাসররাত্রির আসঙ্গেও রণধীর সেই গন্ধের অনুপস্থিতিতে কামার্ত হয়ে উঠতে ব্যর্থ। চল্লিশের দশকের অবিভক্ত ভারতের আইনে মান্টোকে অশ্লীলতার দায়ে তলব করে লাহোরের আদালত। |
'ঠাণ্ডা গোস্ত' গল্পে দেখি, দেশভাগের সময়কার দাঙ্গায় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙানো শিখ যুবক ঈশ্বর সিংহ ঘরে ফিরে কিছুতেই প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারছে না। প্রেমিকার সন্দেহ, তার মরদ নিশ্চয় অন্য নারীসঙ্গে মজেছে। ঈর্ষার জ্বালায় ঈশ্বরের কৃপাণ কোষমুক্ত করে সে ক্ষতবিক্ষত করে তাকে। মুমূর্ষু ঈশ্বর স্বীকার করে, সে এক অচেতন মুসলিম বালিকাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারে আসলে সে বালিকাটির শবের সঙ্গে... আখ্যানের তীব্র সংবেদনশীলতা বোঝেনি পাকিস্তান। 'আমরা মুসলমানরা এতই আত্মমর্যাদারহিত যে আমাদের মৃত কন্যাদেরও শিখরা ধর্ষণ করে যায়?'—এমন প্রশ্ন তুলে লাহোর আদালতে মামলাও ঠুকে দেয় পাক আমলাতন্ত্র। মান্টো তাঁর সাধের মুম্বই ছেড়ে কেন পাকিস্তানে চলে গেলেন, তা নিয়ে জল্পনা আজও শেষ হয়নি। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত এ শহরেই তাঁর বোহেমিয়ান দিনযাপন, চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে দহরম-মহরম, ফিল্মের চিত্রনাট্য রচনা থেকে পতিত, পাপী-তাপী, মাতাল-বেশ্যাদের ডেরায় ঘুরে বেড়ানো। তবে কেন তিনি ভারত ছাড়লেন? কারণ মুম্বই, বস্তুত সমগ্র উত্তর ভারতই, আর তত দিনে তত সেকুলার নেই, তার ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক শপথের আড়াল থেকে উঁকি মারছে মুসলিমদের একঘরে করার, কাজ না দেওয়ার, ভাতে-পানিতে মারার, হুমকি দিয়ে তাড়ানোর প্রচ্ছন্ন চক্রান্ত। পাকিস্তানে গিয়েও কিন্তু মান্টো লিখছেন 'দ্বিজাতিতত্ত্ব'র মতো গল্প, যাতে প্রতিবেশী হিন্দু বালিকা শারদার প্রেমে পড়া মুসলিম কিশোর মুখ্তার 'প্রেমের ধর্মের কাছে আর সব ধর্মই তুচ্ছ' ঘোষণা করেও বিয়ের জন্য প্রেমিকাকে ইসলাম গ্রহণে চাপ দেয়। শারদা যখন পাল্টা তাকে হিন্দু হতে বলে, তখনই মুখ্তার ইসলামের উৎকর্ষ আর পৌত্তলিক ও গোময়পায়ী হিন্দুত্বের অপকর্ষ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে 'বুকের মধ্যে ইসলাম গুঁজে নিয়ে' শারদার বন্ধ দরজা থেকে ফিরে আসে। কিংবা মনে করুন আর এক হাড়-হিম-করা গল্প 'ফিরে আসা', যাতে দাঙ্গায় স্ত্রী-হারানো সিরাজুদ্দিন পরমাসুন্দরী কন্যা সাকিনাকে উদ্ধার করতে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ করেন। কিছু দিন পর স্ট্রেচারে-শোয়া অচেতন মেয়েকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে দেখে ফিরে-পাওয়ার আনন্দে সিরাজুদ্দিন পিছু-পিছু ঢোকেন। ডাক্তার তাঁকে ঘরে আলো আসার জানলা দেখিয়ে বলেন, 'খুলে দাও'। অর্ধচেতন সাকিনা তৎক্ষণাৎ নিজের সালোয়ারের দড়ি আল্গা করে নামিয়ে দু'পা ফাঁক করে দেয়। এত অসংখ্য বার সে বিধর্মী হিন্দু ও স্বধর্মী মুসলিমদের দ্বারা ধর্ষিত, যে 'খুলে দাও' উচ্চারণে সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় তার হাত সালোয়ারের দড়িতে চলে যায়। এমন গল্পকারকে পাকিস্তানই বা কী করে হজম করবে? ১৯৫০ সালে মান্টো স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রুপে লেখেন, 'এক দিন হয়তো পাকিস্তানের সরকার আমার কফিনে একটা মেডেলও পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।' পাকিস্তানের জন্মের ৬৫ বছর উপলক্ষে গত অগস্টে পাক সরকার ঠিক সেটাই করেছে। সাদাত হাসান মান্টোকে তারা 'নিশান-এ-ইমতিয়াজ' উপাধিতে ভূষিত করেছে, যিনি তাঁর 'এপিটাফ'-এ লিখে গিয়েছিলেন, 'এই সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই ছোটগল্পকার, যে ভাবছে, খোদা, নাকি সে নিজে, কে বেশি ভাল গল্পকার!' মৌলবাদীদের হামলার ভয়ে মান্টোর পরিবার তাঁর সমাধিতে এটা খোদাই করার সাহস পায়নি। http://www.anandabazar.com/21edit3.html সাদাত হাসান মান্টো এখনও ভাবায় আ হ মে দ তে পা ন্ত র সাদত হাসান মান্টো। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ক্ষণজন্মা গল্পকার, চিত্রনাট্যকার, অনুবাদক এবং একইসঙ্গে সংলাপ রচয়িতা। বিংশ শতকে এমন ক্ষণজন্মা প্রতিভাধর শক্তিশালী লেখকদের অগ্রজ প্রতিনিধি বলা হয় তাকে। যদিও এ আলোচনা যতটা ভারতে, ঠিক ততখানি পাকিস্তানে নয়। হালে তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে তরুণ প্রজন্ম। মানবসচেতন অসাম্প্রদায়িক লেখক সাদত হাসান মান্টো ১৯১২ সালের ১১ মে ব্রিটিশ শাসিত পাঞ্জাবের (বর্তমান পাকিস্তান) লুধানিয়া জেলার সামরালা শহরে শিক্ষিত কাশ্মীরি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সাদত হাসান মান্টো মূলত মানবতাবাদী ইতিহাসআশ্রিত ছোট গল্পকার। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড তার সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলেছে। এজন্য তাকে ব্রিটিশ সাহিত্যিক ডি. এইচ. লরেন্সের সঙ্গে তুলনা করা হতো। মান্টোর মতো লরেন্সও অল্প বয়সে মারা যান। দ্য হিন্দু'র আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, 'মান্টোকে আজও ভারতীয়রা স্মরণ করে; কারণ তার লেখায় ভারত-পাকিস্তানের মর্মান্তিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে যেমন এর কুিসত চেহারা ফুটে উঠেছে, তেমনি সাম্প্রদায়িকতার নগ্নতা দেখতে পাই ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে দাঙ্গা কিংবা ২০০২ সালে গুজরাটে অসংখ্য মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে।' আলোচনায় তারা আরও বলেন, 'মান্টো হচ্ছেন সত্যিকারের চিত্রনাট্যশিল্পী।' মান্টো একাধারে উর্দু ছোট গল্পকার, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা ছিলেন। ভারতের বলিউডের আধুনিক চিত্রনাট্যের জনক বলা হয় তাকে। মান্টো ১৯৩১ সালে অমৃতসরে হিন্দুসভা কলেজে পড়ার সময় 'তামাশা' গল্প লেখেন। গল্পটি ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে রচিত। পণ্ডিত আবদুল বারী আলিগের পরামর্শে মান্টো তার জীবনের প্রথমে ভিক্টর হুগোর 'দ্য লাস্ট ডেইজ অব এ কনডেম্ড ম্যান' (একজন কয়েদির গল্প)-এর উর্দু অনুবাদ লেখেন। এরপর তিনি লুধানিয়া থেকে প্রকাশিত উর্দু 'মাসোয়াট' পত্রিকায় চাকরি নেন। এরপর তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। অনুবাদে তার প্রতিভা দেখে পণ্ডিত আবদুল বারী আলিগ তাকে উত্সাহিত করেন রুশ এবং ফ্রান্স-সাহিত্য বেশি করে পড়ার ব্যাপারে। এদের মধ্যে লর্ড লিটন, ম্যাক্সিম গোর্কি, নাট্যকার চেখভ, রুশ গল্পকার পুশকিন, অস্কারওয়াইল্ড, ইতালির বিশ্বখ্যাত গল্পকার মঁপাসা উর্দু ভাষায় অনুবাদ করে নিজের ভিত মজবুত করেন। মান্টো তখন ২১ বছরের তরুণ। পরে নিজের ভিতের ওপর শুরু করেন স্বকীয় লেখা, যা তাকে ভারতীয় উপমহাদেশে শ্রেষ্ঠ লেখকদের কাতারে দাঁড় করিয়েছে। এরপর মান্টো গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেখানে তিনি পরে শিক্ষকতাও করেন। সাহিত্যকর্মে আরও বেশি মনোনিবেশ করার জন্য তিনি ভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘের সদস্যপদ লাভ করেন। সেখানে তিনি নতুন করে আবিষ্কার করেন এবং লেখেন, 'ইনকিলাব পছন্দ' যা ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এরপর অবশ্য মান্টোকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কারণ ১৯৩৬ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্রথম প্রকাশ হয় উর্দু গল্পগ্রন্থ 'আটিশ পারে'। এরপর মান্টো আলীগড় ছেড়ে পাড়ি জমান লাহোরে, পরে বোম্বে। চলচ্চিত্রের প্রতি ছিল তার অসামান্য ঝোঁক। সেই ঝোঁক থেকে ১৯৩৬ সালে মূলত তার মুম্বাই শহরে আসা। কয়েক বছর তিনি মুম্বাইয়ে কাটান। সেখানে তিনি 'মুসাফির' নামে একটি মাসিক চলচ্চিত্র ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। একইসঙ্গে তিনি শুরু করেন চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখার কাজ। ১৯৩৬ সালে হিন্দি ছবি 'কিষান কানাইয়া' এবং ১৯৩৯ সালে 'আপনি নাগরিয়া'র চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেইসঙ্গে অর্থের সমাগমও ঘটে। ১৯৩৯ সালের ২৬ এপ্রিল বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সাফিয়া। মান্টো তিন কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন। আজকের মান্টো দু'ভাবে আলোচনায় আসেন। প্রথমে উর্দু ছোট গল্পকার। দ্বিতীয় ভাগে চিত্রনাট্যকার এবং সংলাপ রচয়িতা। এই ভাগে তিনি মুম্বাই তথা ভারতবর্ষে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি যখন ভারত ত্যাগ করেন, তখন অনেকেই তাকে পাকিস্তানে ফিরতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন অশোক কুমার, নূরজাহান নাসিমসহ অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী। এছাড়া বিখ্যাত লেখিকা ইসমত চুগতাইও ছিলেন তার অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী। জানা যায়, চুগতাইয়ের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সে সময় তাদের সম্পর্ক বেশ আলোচনার খোরাক জুগিয়েছিল। অবশ্য শেষপর্যন্ত মান্টোর নীরবতা ও চলে যাওয়ায় সেই আলোচনায় যবনিকাপাত ঘটে। দেশে ফেরার পর তিনি লেখেন তার বহুল বিতর্কিত 'খুল দো' এবং 'ঠাণ্ডা গোশত' নামে দু'টি আক্রমণাত্মক গল্প। ওই সময় দেশজুড়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে এ নিয়ে। দেশ ভাগ হলে মান্টো সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানে লাহোরে ফেরার। ১৯৪৮ সালে বন্ধুদের অনুরোধ সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে জন্মভূমে ফেরেন। এখানে শুরু হলো মান্টোর তৃতীয় এবং শেষ অধ্যায়। তিনি ভেবেছিলেন, দেশ ভাগ হলে সাম্প্রদায়িক চেতনা ও শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু খ্যাতি-যশ মুম্বাই ফেলে মান্টো পাকিস্তানে মারাত্মক অর্থকষ্টে পড়েন। দেশে তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এমন উপলব্ধি থেকে তিনি রচনা করেন রাজনৈতিক প্রহসনমূলক গল্প 'তোবা টেক সিংহ'। এটা নিয়ে একটা গল্প চালু আছে। জানা গেছে, তার চরম অর্থসঙ্কটে একবার লাহোরের বিখ্যাত ওয়াএমসিএ হলে এক অনুষ্ঠানে তার লেখা প্রহসন 'তোবা টেক সিংহ' পাঠ করছিলেন। তার বক্তব্য উপস্থাপনে হলে পিনপতন নীরবতায় অনেক শ্রোতা-দর্শকের চোখে পানি দেখা গেছে। পরে তোবা টেক সিংহ নিয়ে অপর পাকিস্তানি নারী আফিয়া নাথানিয়েল ২০০৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এ সময় অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যাপক ও অনেকটা এলোমেলোভাবে লেখালেখি শুরু করেন, যা তারে খ্যাতিতে কিছুটা কালিমা দেয়। শেষদিকে তিনি কখনোই কারও থেকে নিজের সমালোচনা শুনতে পারতেন না। এজন্য পরে সবাই তাকে এড়িয়ে গেছে। মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে একদিকে যেমন পাকিস্তান একজন মানবতাবাদী লেখককে হারায়, তেমনি আজও ভারত মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে এমন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মান্টোকে। কারণ তার উল্লেখযোগ্য কর্মময় জীবন কেটেছে মুম্বাইয়ে। তাই তো মান্টোকে নিয়ে ভারতভিত্তিক 'দ্য হিন্দু'তে দেখা যায় সাম্যের জয়গান। সেখানে দাবি করা হয়, 'সবচেয়ে ভালো হতো যদি দুই দেশে মান্টোর জন্মশতবর্ষ পালিত হতো।' ভাগ – সাদাত হাসান মান্টোLeave a reply তর্জমা: সামসুদ্দোজা সাজেন সবচেয়ে বড় সিন্দুকটাই সে বাছাই করেছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কাঠের সিন্দুকটা নাড়াতে পারল না। আরেকজন অনেক খোঁজাখুজির পর মূল্যবান কিছু না পেয়ে প্রথম ব্যক্তির নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, 'তোমার কোন সাহায্য লাগবে?' প্রথম ব্যক্তি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে সাহায্যকারী লোকটি পেশীবহুল হাত দিয়ে ভয়ংকর ভারি সিন্দুকটি চওড়া কাঁধে তুলে নিল। রাস্তায় উঠতে উঠতেই বহনকারীর মনে হল সিন্দুকের ভারে তার কোমর নইলে পা দুটো ভেঙ্গে যাবে। তারপরও ভাগের আশায় সে বয়ে নিয়ে চলল। সিন্দুক দখল করা লোকটি গায়ে গতরে তেমন বলশালি ছিল না। তারপরও মালিকানা জাহিরের জন্য সে শক্ত করে একটি অংশ আঁকড়ে থাকল। তারা ধীরে ধীরে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে চলল। নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে বহনকারী সিন্দুক নামিয়ে রাখল। কঠোর শ্রম স্বীকারকারী লোকটি এবার জানতে চাইল, 'আমার ভাগ কতটুকু?' 'চার আনা,' জবাব এল। 'ন্যায্য হল না!' 'না? মনে রেখ আমিই পেয়েছিলেম সিন্দুকটা।' 'সেটা ঠিক, কিন্তু আমিই তো পিঠে করে এতটা পথ বয়ে নিয়ে এলাম।' 'আচ্ছা, অর্ধেক অর্ধেক।' 'এই বার হল। চল দেখি ভিতরে কি আছে।' সিন্দুক খুলতেই তরবারি হাতে এক লোক বেরিয়ে এল, তরবারির ঘায়ে দুই অংশীদারকে চার টুকরা করে ফেলল।
পাকিস্তানঃ দেশ বিভাগ আমলের লেখক সাদাত হাসান মান্টো আজও বিদ্যমান |
Tuesday, May 21, 2013
‘সাদাত হাসান মান্টো সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের কথা বলতেই হবে। কেননা দেশ ভাগ মান্টোর সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন সাহসী ও শাণিত লেখক। সাহিত্য মায়ার জগতে নিয়ে যায় পাঠককে। কিন্তু মান্টো সেই মায়ার জগৎ থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসেন মানুষকে। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছেন, পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের ক্ষমতাসীনদের ব্যঙ্গ করেছেন। যেমন তার “টোবা টেক সিং” গল্প তার প্রধান উদাহরণ।’আমরা সে ভাবে তাঁকে পড়লামই না অথচ সাদাত হাসান মান্টো কেবল দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার নন, এই উপমহাদেশের জীবনে তিনি আজও ভয়ানক ভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর জন্মের শতবর্ষ চলে গেল, মোটামুটি নিঃশব্দেই। গৌতম রায়
Subscribe to:
Post Comments (Atom)